ইদের সকালে নমাজ শেষ করার পর কুরবানির প্রস্তুতি চলছিল গ্রামে। আর ওই উৎসব নিয়ে আনন্দে মেতে উঠেছিল গ্রামের একের পর এক বাড়িঘর। কেউ মধ্যাহ্নভোজের জন্য মেনু তৈরি করতে ব্যস্ত। আবার কেউ সাজগোজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। সোমবার সকাল থেকে নির্মলজোত গ্রামের ছবিটা এমনই ছিল। কিন্তু ভয়াবহ কাঞ্চনজঙ্ঘা ট্রেন দুর্ঘটনা পরবের খুশি আর ব্যস্ততাকে একধাক্কায় মাটিতে এনে নামিয়ে দিল। সামনে তখন শুধুই হাহাকার। কুরবানির ইদের দিনে সব ভুলে কর্তব্যটাই বড় করে দেখলেন এই গ্রামের বাসিন্দারা। আনন্দের যাবতীয় পরিকল্পনাকে জলাঞ্জলি দিয়ে ট্রেন দুর্ঘটনায় আহতদের দিকে নির্মল জোত গ্রামের বাসিন্দারাই বাড়ালেন সাহায্যের হাত। স্থানীয় মসজিদ থেকে তখন ঘোষণা করা হল, পরব স্থগিত রেখে দিন। দ্রুত দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে উদ্ধারকাজে হাত লাগান।
এটাই তো বাংলার কৃষ্টি–সংস্কৃতি। যা আরও একবার দেখিয়ে দিল নির্মল জোত গ্রাম। আর মনে করিয়ে দিল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা—ধর্ম যার যার উৎসব সবার। আর এই উৎসবে তাঁরা আনন্দ করলেন না। মানুষকে বাঁচানোর কাজকেই মেনে নিলেন উৎসব হিসাবে। বাইরে তখন মুষলধারায় বৃষ্টি পড়ছে। সৌহার্দ্যের কোলাকুলি সেরে সবাই মিষ্টি মুখ করবেন সেটাও হল না। দুপুরে গ্রামের ঘরে ঘরে কুরবানির মাংস রাঁধা হবে। কিন্তু হল না। কারণ কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসকে পিছন থেকে ধাক্কা মেরেছে মালগাড়ি। মানুষের রক্তে তখন রেললাইন রক্তাক্ত। গোঙানির শব্দ আসছে ভিতর থেকে। ছাতা মাথায় ফজলুর, তালেব, মফিজরা এগিয়ে গেলে উদ্ধারে।
আরও পড়ুন: সরাসরি সংঘাতে জড়াল বাম–কংগ্রেস, দুই আসনে প্রার্থী ঘোষণা করতেই জোটে জট
বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা ফাঁসিদেওয়া ব্লকের মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামগুলির মধ্যে রয়েছে নির্মলজোত। এই গ্রামে দেড়শো পরিবারের বসবাস। বেশিরভাগ মানুষই কৃষিজীবী। ইদ নিয়ে গ্রামবাসীরা ব্যস্ত ছিলেন। বৃষ্টি ও মেঘলা আকাশকে মাথায় নিয়েই মসজিদে নমাজ পড়তে গিয়েছিলেন পুরুষরা। মহিলারা বাড়িতে নমাজ পড়ার পর খাবারের আয়োজনে ব্যস্ত ছিলেন। বাড়িতে বাড়িতে শুরু হয়েছিল কুরবানির প্রস্তুতি। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে বদল হয়ে গেল পরিস্থিতি। ভয়ঙ্কর কাণ্ড দেখে সবাই ছাতা ফেলে ছুট লাগালেন রেললাইনের দিকে। পুলিশ, অ্যাম্বুল্যান্সকে খবর দিয়েই ভেঙে তছনছ হয়ে যাওয়া কামরার ভিতর থেকে নিহত–আহত রেলযাত্রীদের বের করে আনার কাজটা শুরু করলেন মফিজরা। এটাই তখন বড় কাজ হয়ে দাঁড়াল তাঁদের কাছে।
এছাড়া পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছনোর আগে ট্রেন থেকে জখম যাত্রীদেরকে কাঁধে তুলে নিয়ে অ্যাম্বুল্যান্সে রেখে দেন ফজলুর, তালেব, মফিজরা। এই কাজ করতে গিয়েই পেরিয়ে গেল কুরবানির সময়। বাড়ির বধূ নাসমিন পারভিন বলেন, ‘দুপুরে বাড়িতে বিরিয়ানি ও কষা মাংস হবে ঠিক হয়েছিল। কুরবানির মাংস প্রতিবেশীদের মধ্যে বণ্টন হবে বলে পরিকল্পনা চলছিল। হঠাৎ বিকট আওয়াজ সবাই শুনতে পেলাম। রেললাইনের দিকে তাকিয়ে দেখি, একটি ট্রেনের উপর উঠে গিয়েছে আর একটি ট্রেন।’ আর একটা বাচ্চা মেয়ের তখন মাথা থেকে অঝোরে রক্ত বের হচ্ছিল। ফজলুর তাঁকে কোলে তুলে নিয়ে বলেন, ‘মেয়েটাকে দেখে আমার মেয়ে ফরজানার কথা মনে পড়ল। মেয়েটাকে কোলে নিয়ে সোজা রাঙাপানিতে পৌঁছে পরিচিত একজনকে দিয়ে ফাঁসিদেওয়া হাসপাতালে পাঠালাম। আসলে ইদের দিন এমন দৃশ্য দেখব ভাবিনি।’