দেখতে দেখতে চলেই এল বাঙালির প্রিয় দুর্গোৎসব। আর কিছুদিন বাদেই ঢাকে কাঠি পড়ল বলে। পুজো মানেই তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকবে খাওয়াদাওয়া। আর পুজোর খাওয়াদাওয়া নিয়ে এই বছর কিছু দরকারি পরামর্শ দিচ্ছেন ডায়বেটোলজিস্ট ও ওবেসিটি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আশিস মিত্র।
১) পুজোয় জাঙ্ক ফুডের লোভ এড়ানো কঠিন! সে ক্ষেত্রে ফিট থাকতে কী করণীয়?
চিকিৎসক: জাঙ্ক ফুড বলতে আমরা মূলত ফাস্ট ফূডকে বুঝি। ফাস্টফুড এর মাধ্যমে আমাদের শরীরে প্রচুর পরিমাণে ফ্যাট ও সুগার পৌঁছে যায়। তাই পূজোয় জাঙ্ক ফুড খেলেও তা খেতে হবে সীমিত পরিমাণে অর্থাৎ একটা রোল অথবা একটা চাউমিন এক বেলা খেলে ঠিক আছে। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিতভাবে পুজোর বলে সব বেলাতেই জাঙ্ক ফুড খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। অনেকে ব্যায়াম করে অতিরিক্ত ফ্যাট ঝরিয়ে ফেলতে পারেন। কিন্তু বেশিরভাগেরই ব্যায়াম করার অভ্যাস থাকে না। এই অভ্যাসটা ফিরিয়ে আনা জরুরি। হেঁটেই করতে পারলে অতিরিক্ত ফ্যাট ঝরে যায়। তবে তা না করলে খাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
২) পুজোর ক'টা দিন রাত জেগে ঠাকুর দেখার পর বহু সময়ই অনেক রাতে খাওয়া হয়, রুটিন ঠিক থাকে না। এই অবস্থায় ফিট থাকার টিপস কী?
চিকিৎসক: রাত জেগে ঠাকুর দেখার ব্যাপারে দু'রকম সমস্যা হতে পারে। যাদের ডায়াবিটিস বা হার্টের সমস্যা নেই, তারা দেরি করে খাবার খেলে হজম সমস্যা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে হজমের সমস্যা দূর করার জন্য খাবারের সঙ্গে যে কোন হজমের ওষুধ অল্প পরিমাণে খেয়ে নেওয়াটা জরুরি। যাদের হার্টের সমস্যা ও ডায়াবেটিস রয়েছে, তারা দেরিতে খাবার খেলে রক্তে সুগারের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। এছাড়াও আমাদের শরীরের হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। কর্টিসল, ইনসুলিনের মত হরমোনগুলি আমাদের শরীরের সুগারের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। রাতে না ঘুমিয়ে প্যান্ডেল হপিং করলে হরমোনের ভারসাম্য কিন্তু নষ্ট হবেই। সকালে ঘুমিয়েও সেই ভারসাম্য ফেরানো যায় না।
৩) প্যান্ডেল হপিং এর ফাঁকে জল খাওয়ার কথা মাথায় থাকে না... সেক্ষেত্রে ঠাকুর দেখতে বেড়িয়ে হাইড্রেটেট থাকার টিপস কী? কতটা জল পুজোর ব্যস্ততার মাঝে অন্ততপক্ষে দরকার?
চিকিৎসক: এই বছর পুজো বেশ কিছুটা আগেই শুরু হচ্ছে। এই সময় প্রচন্ড গরম ও হিউমিডিটি থাকবে। তাই প্যান্ডেল হপিংয়ের সময় জল খাওয়ার কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয়, যদি সঙ্গে একটি ওআরএস-এর বোতল থাকে। এটা সবচেয়ে সায়েন্টিফিক। শরীর হাইড্রেটেড রাখতে ২১ গ্রামের ওআরএস প্যাকেট কিনে এক লিটার জলে গুলে নিতে হবে। বোতলটি ঠাকুর দেখার সময় সঙ্গে রাখুন ও মাঝে মাঝে জল খান। ওআরএস-এর সেরা বিকল্প হলো ডাবের জল। যদি রাস্তায় ডাবের জল পাওয়া যায় তাহলে সেটিও খাওয়া যেতে পারে। এছাড়া, সাধারণ জলও শরীর হাইড্রেটেড রাখে। তবে ফ্রুট জুস বা কোল্ড ড্রিঙ্কস জাতীয় পানীয় একেবারেই খাওয়া যাবে না। এতে শরীর হাইড্রেটেড হওয়ার বদলে ডিহাইড্রেটেড হয়ে যায়।
৪) অষ্টমীর দিন অঞ্জলী অনেকক্ষণ উপোস থাকার পর লুচির লোভ সামলানো মুশকিল! পরবর্তীতে অম্বল, বুক জ্বালার সমস্যা রুখতে কী করা যায়?
চিকিৎসক: কখনই ১২ ঘণ্টার বেশি উপোস করা উচিত নয়। তাতে শরীরে নানান রকম সমস্যা দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে যাদের সুগার বা প্রেশার রয়েছে, তাদের শরীরে আরও জটিলতা দেখা দিতে পারে। কারও ক্ষেত্রে প্রেশার ফল করতে পারে। কারও ক্ষেত্রে সুগার ফল করে যেতে পারে। তাই একেবারে না খেয়ে উপোস না করাই ভালো। আবার উপোস ভাঙার পর হালকা খাবার খাওয়াই সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর। তাই অষ্টমীর অঞ্জলি দেওয়ার পর যাঁরা লুচি বা তেলে ভাজা জাতীয় খাবার খাচ্ছেন, তারা একই সঙ্গে একটি অ্যান্টাসিড খেতে পারেন নিজেকে নিরাপদ রাখার জন্য। অ্যান্টাসিড খেলে লিকুইড বেছে নেওয়াই স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। কারণ ট্যাবলেট জাতীয় ওষুধে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থাকতে পারে।
৫) পুজোয় বাঙালির অন্যতম প্রিয় পদ পাঠার মাংস। এদিকে রেড মিট বলে এটি হার্টের জন্য ক্ষতিকর। সেক্ষেত্রে কীভাবে খেলে হার্টের সমস্যা এড়ানো যায়?
চিকিৎসক: পুজোর সময়ের পাঁঠার মাংস যদি একান্তই খেতে হয়, তাহলে খাসির মাংসের বদলে রেওয়াজি মাংস খাওয়াই স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ। কারণ এতে খারাপ ফ্যাটের পরিমাণ কম। কিন্তু তাই বলে যত ইচ্ছে খেলেও হবে না। সীমিত পরিমাণে খেতে হবে। তাহলে হার্টের সমস্যা এড়ানো যাবে।
৬) পুজো মানেই হইহুল্লোড়। আর তার সঙ্গে মদ্যপানের একটা প্রবণতা দেখা যায়। সেক্ষেত্রে কী সতর্কতা জরুরি?
চিকিৎসক: আমাদের দেশ গ্রীষ্মপ্রধান দেশ। মূলত শীত প্রধান দেশে অ্যালকোহল খাওয়া হয়। তাই অ্যালকোহল অত্যাধিক পরিমাণে খেলে ডিভাইডেশনের সমস্যা হতে পারে, এটা মনে রাখতে হবে। এছাড়াও মনে রাখতে হবে মদ্যপানের সময় কাবাব, বাদাম ইত্যাদি ফ্যাট জাতীয় খাবার না খাওয়াই ভালো। কারণ এতে স্বাস্থ্যের আরও ক্ষতি হয়। লিভারের সমস্যা হয়। এর বদলে স্যালাড লিভারের জন্য স্বাস্থ্যকর। আর একান্তই অ্যালকোহল খেতে হলে রেড ওয়াইন খাওয়া সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর, কারণ এটি হার্টের জন্য ভালো।
৭) বাইরের খাবার খাওয়ার ব্যাপারে কী কী সচেতনতা থাকা জরুরি?
চিকিৎসক: বর্ষার এই মরসুমে অনেকেরই পেট খারাপ হচ্ছে। সেপ্টেম্বরের শেষেও মোটামুটি এমনই আবহাওয়া থাকতে পারে। তাই পুজোয় বাইরের খাবার খাওয়ার সময় কিছু ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। যেমন কাটা ফল, কুলফি ইত্যাদি এড়িয়ে চলা ভালো। ফুচকার জল না খাওয়াই ভালো। এই জল থেকে শুধু পেট খারাপ নয়, টাইফয়েড ও হেপাটাইটিসের মতো সমস্যাও দেখা দিতে পারে। এতে পুজোর আনন্দ মাটি হবে শেষকালে।
পাঠকদের প্রতি: প্রতিবেদনটি চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে তাঁর মতামতের ভিত্তিতে লেখা হয়েছে। এটি সমস্যাটি সম্পর্কে সাধারণ ধারণার উপর আলোকপাত করা মাত্র। ব্যক্তিবিশেষে প্রতিটি সমস্যার চিকিৎসা এবং নিরাময়ের পদ্ধতি পৃথক। তাই যে কোনও সমস্যায় শুধুমাত্র এই প্রতিবেদনের কথায় ভরসা না রেখে, ব্যক্তিগতভাবে চিকিৎসকের বা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।