চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামের ট্র্যাজেডির পরবর্তী সময়ে বিরাট কোহলিকে কি সহজ টার্গেট বানানো হয়েছে? কী অদ্ভুতভাবে আমরা আমাদের নায়কদের প্রতি মুখ ফিরিয়ে নিই। কতটা উৎসাহ আর যত্নে আমরা তাদের মাথায় তুলে দিই, আবার ঠিক ততটাই দ্রুততার সঙ্গে তাদের নীচে নামাতে শুরু করি।
বলা ভুল হবে না, যে বিরাট কোহলির রয়েছে ক্রিকেটবিশ্বের সবচেয়ে অনুগত সমর্থক। ভারতের প্রাক্তন অধিনায়ক একজন নিশ্চিত জনমোহিনী ব্যক্তিত্ব, যার ক্রিকেটীয় ক্যারিশমা কোটি কোটি মানুষের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করেছে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে একা হাতে বহু সমর্থকের আশা-প্রার্থনা বহন করে এসেছেন এবং প্রায়শই নিরাশ করেননি—একটির পর একটি মহাকাব্যিক ইনিংস উপহার দিয়েছেন নিয়মিতভাবে।
রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর হয়ে ১৮ বছরে প্রথম আইপিএল শিরোপা জেতা যেন তার ট্রফি-ভরা ঝুলিতে শেষ স্পর্শ হওয়ার কথা ছিল। ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ট্রফিটাই শুধু বাকি থাকবে তার ঝুলিতে। চারদিন আগেই আমদাবাদে যে অধরা ট্রফিটি এল, কোহলিই ছিলেন সেই সাফল্যের মূল ইঞ্জিন—এই মরশুমে তিনি তৃতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হয়েছেন, এবং সেই রান এসেছে স্ট্রাইক রেট, স্টাইল, আর ধারাবাহিকতার দুর্দান্ত মিশেলে।
মঙ্গলবার রাতে পঞ্জাব কিংসের বিরুদ্ধে আরসিবির ৬ রানে জয় সারা বিশ্বের আরসিবি-ভক্তদের আবেগে ভাসিয়ে তোলে। বেঙ্গালুরু শহরে রাস্তায় নিজে থেকে পার্টি শুরু হয়ে যায়, চলে রাতভর। কোহলিই ছিলেন উচ্ছ্বাসের কেন্দ্রবিন্দু—১৭ বছর ধরে একা হাতে দলটির জনপ্রিয়তা বজায় রেখেছেন, মাঠে সাফল্য না এলেও। যখন অবশেষে জয়ের ফিতা কাটা গেল, সেটা ছিল এক রকমের ন্যায্য প্রাপ্তি—কোহলি এবং তার অনুগত সমর্থকদের জন্য।
কিন্তু এখন সেই কোহলিই সামাজিক মাধ্যমে বিদ্বেষ আর কটাক্ষের শিকার। আজকের দিনে সোশ্যাল মিডিয়ার পরিবেশ ক্রমেই বিষাক্ত হয়ে উঠছে, যেখানে পরিচয় গোপন রেখে মানুষ বিনা দ্বিধায় ঘৃণা ছড়াতে পারে। বুধবার সন্ধ্যায় বেঙ্গালুরুর এম. চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামের বাইরে যে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটল, তা এক নিমিষে আনন্দমুখর পরিবেশকে শোকস্তব্ধ করে দেয়। এই ঘটনার পরেই বিরাট কোহলিকে দোষারোপ করা হয়, তিনি নাকি পরিস্থিতির গুরুত্ব না বুঝে মাঠের ভিতরে উদযাপন চালিয়ে গিয়েছিলেন।
কিন্তু প্রত্যেকেই বিভিন্ন পরিস্থিতিতে আলাদাভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়। এ নিয়ে কোনও নির্দিষ্ট ছাঁচ চলে না এবং আমরা কারও কাছে এমন আচরণের প্রত্যাশা করতে পারি না যা আমাদের পছন্দসই। বিকেল ৩টা নাগাদ চিন্নাস্বামীর বাইরে যে ঠেলাঠেলি শুরু হয়েছিল, তা অভিজ্ঞতা না করলে বোঝা যাবে না সেই আতঙ্ক, হৃদয়ের ধুকপুক, অ্যাড্রিনালিনের ঢেউ আর আত্মরক্ষার মানসিকতা কীভাবে কাজ করে।
হ্যাঁ, আমদাবাদে জয়ের পর মাত্র ১৫ ঘণ্টার মধ্যে বেঙ্গালুরুতে আয়োজিত সেই তড়িঘড়ি করা উদযাপনের পিছনে কোহলির উপস্থিতি থাকতে পারে। কিন্তু সে অনুষ্ঠানের দায় তার নয়। কারণ কোহলির লন্ডন রওনা হওয়ার তাড়ায় অনেকেই নিজের লাভ দেখেই গোটা অনুষ্ঠান সাজাতে তৎপর হয়ে পড়ে, উপেক্ষা করে পুলিশি সতর্কতা ও প্রোটোকল। যদি সময় পাওয়া যেত, তবে নিশ্চয়ই সঠিক নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া যেত এবং দুর্ঘটনা এড়ানো যেত।
অনুষ্ঠান বাতিল করলে আরও অশান্তি হত
অনেকে বলছেন, কোহলির উচ্ছ্বসিত উদযাপন ছিল অমানবিক, যখন স্টেডিয়ামের বাইরে মৃত্যু ঘটেছে ১১ জনের (যেমনটা পরে জানা গেছে)। কিন্তু যাঁরা অনুষ্ঠানটি দেখেছেন, তাঁরা বুঝতে পেরেছেন—কোহলি শুধু দায়বদ্ধতা থেকেই মঞ্চে ছিলেন। কোথাও তার মধ্যে সেই চেনা উল্লাস, ভক্তদের সঙ্গে জোরদার সংযোগ বা আবেগপ্রবণ উদযাপন দেখা যায়নি। অনুষ্ঠানের পুরোপুরি বাতিলের প্রস্তাব অনেকেই দিয়েছেন। কিন্তু সেটা কি তখনকার বাস্তবতায় সম্ভব ছিল? মনে রাখতে হবে, তখনও স্টেডিয়ামে থাকা ৩৫ হাজার দর্শকের বেশিরভাগই জানতেন না বাইরে কী ঘটেছে। পুরো অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিলে পরিস্থিতি আরও বিশৃঙ্খল হতো, ছড়িয়ে পড়তে পারত হিংসা। ফোন নেটওয়ার্কও সেই সময় বিপর্যস্ত ছিল—কারণে হোক বা অকারণে—ফলে তথ্যের আদান-প্রদান ছিল প্রায় অসম্ভব।
এই অবস্থায় কোহলি যা করেছেন, তা যথেষ্ট সংযতভাবেই করেছেন। তাকে এই দুর্ঘটনার দায়ে অভিযুক্ত করা নেহাতই অন্যায়। যেখানে আরও বহু স্তরে গাফিলতির কারণে এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটেছে, সেখানে কোহলির ঘাড়ে দোষ চাপানো মানে আসল সমস্যাগুলো এড়িয়ে যাওয়া।একজন খেলোয়াড়কে অপরাধী বানিয়ে কি আমরা আমাদের দায়িত্ব শেষ করছি?