সংসদে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রস্তাবিত সংবিধান (১১৩ তম সংশোধনী) বিলকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিতর্ক। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বুধবার লোকসভায় যে বিলটি পেশ করেছেন তার মূল বিষয় হল, কেন্দ্রের মন্ত্রী, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, এমনকী প্রধানমন্ত্রীকেও যদি কোনও মামলায় একমাসের জন্য আটক বা গ্রেফতার করা হয় তা হলে মাস পেরনো মাত্র তাঁকে দায়িত্ব থেকে সরে যেতে হবে। লোকসভায় বিরোধীদের তুমুল বাধার মুখে পড়েছে কেন্দ্রের ওই বিল। কংগ্রেস-সহ বিরোধী দলগুলির বক্তব্য, এই বিলটিকে 'একটি বিপজ্জনক ও অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ' বলে আখ্যা দিয়েছে।
ইন্ডিয়া জোট মনে করছে, এই বিল কার্যকর হলে কেন্দ্রীয় সরকার বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলক মামলার ভিত্তিতে তাদের জেলে পাঠিয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পদচ্যুত করতে পারবে। এর ফলে জনগণের ভোটে নির্বাচিত নেতৃত্বকে বিচার ছাড়াই সরিয়ে দেওয়া যাবে, যা ভারতের সাংবিধানিক কাঠামোর সম্পূর্ণ বিরোধী। এই প্রসঙ্গে কংগ্রেস সাংসদ প্রিয়াঙ্কা গান্ধী বলেন, 'আমি একে সম্পূর্ণরূপে স্বৈরাচারী এবং অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ বলে মনে করি। এটিকে দুর্নীতি বিরোধী পদক্ষেপ হিসেবে আখ্যা দেওয়া আসলে জনগণের চোখে ধুলো দেওয়া। আগামীকালই যদি কোন বিরোধী মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করে তাকে ৩০ দিনের জন্য গ্রেফতার করা হয়, তাহলে কি তিনি স্বয়ংক্রিয়ভাবে পদ হারাবেন? এটা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর বিরুদ্ধে।'
আরও পড়ুন-কপি ছিঁড়ে প্রতিবাদ… TMCর বিস্ফোরক অভিযোগ হেনস্তা ঘিরে! শাহের পেশ করা বিল জেপিসি-তে
অন্যদিকে, বিশিষ্ট আইনজীবী ও কংগ্রেস নেতা অভিষেক মনু সিংভি এই বিলের তীব্র সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, 'বিজেপি বুঝতে পেরেছে তারা ভোটে হারতে বসেছে, তাই এখন বিরোধী সরকারগুলিকে ভেঙে ফেলার জন্য আইনি হাতিয়ার বানাতে চাইছে। তারা কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলিকে দিয়ে বিরোধী নেতাদের গ্রেফতার করাবে, আর এই বিল কার্যকর হলে সেই নেতাদের বিচার না-হতেই পদচ্যুত করে দেবে।' বিরোধীরা এই প্রস্তাবিত বিলকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে দিল্লির প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের উদাহরণ টানেন। তিনি ২০২৪ সালের মার্চ মাসে আবগারি নীতি দুর্নীতির মামলায় গ্রেফতার হন এবং সুপ্রিম কোর্ট থেকে জামিন পাওয়ার আগে পর্যন্ত পাঁচ মাসেরও বেশি সময় জেলবন্দি ছিলেন। যদিও তার বিরুদ্ধে এখনও কোন অভিযোগ প্রমাণ হয়নি, বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়নি, তবুও বিজেপি ও তার মিত্ররা তার পদত্যাগ দাবি করে। কেজরিওয়াল সেই সময় বলেছিলেন, 'আমি এখনও দোষী সাব্যস্ত হইনি, আমার বিচার পর্যন্ত হয়নি, তাহলে কেন আমি পদত্যাগ করব?'
একই রকম ঘটনা ঘটেছে তামিলনাড়ুতেও, যেখানে ডিএমকে নেতা ও রাজ্যের মন্ত্রী ভি সেন্টিল বালাজিকে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। মুখ্যমন্ত্রী এমকে স্ট্যালিন তাঁকে মন্ত্রী হিসেবে বহাল রাখলেও তার দফতর ছিনিয়ে নেওয়া হয়। রাজ্যপাল আর এন রবি এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করলে তা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। পরে চাপের মুখে বালাজি পদত্যাগ করেন। বিভিন্ন বিরোধী দল একযোগে এই বিলের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছে। আরএসপি’র সাংসদ এন কে প্রেমচন্দ্রন বলেন, 'এই বিলের উদ্দেশ্য খুবই স্পষ্ট-বিজেপি বিরোধী দলগুলির সরকার ভেঙে দিতে চাইছে। কেন্দ্র সরকারের অধীনে থাকা সংস্থাগুলিকে ব্যবহার করে তারা বিরোধীদের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলক মামলা করছে। এখন সেই অবৈধ কাজকে আইনি বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা চলছে।' এআইএমআইএম প্রধান আসাদুদ্দিন ওয়েইসি বলেন, 'বিজেপি আমাদের দেশকে পুলিশ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাইছে। তারা পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ মডেল অনুসরণ করছে, যেখানে বিরোধী নেতারা হয় জেলে থাকে না হয় দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু ভারতের গণতন্ত্র এত সহজে ভাঙবে না। আমরা এই বিলের তীব্র বিরোধিতা করব।'আরজেডি নেতা সুধাকর সিং বলেন, 'এটা ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্য এক বিপজ্জনক মোড়। আজ বিরোধী নেতাদের জেলে পাঠিয়ে তাদের ক্ষমতা থেকে সরানোর পরিকল্পনা চলছে, কাল দেশের বাকস্বাধীনতা ও নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়েই প্রশ্ন উঠবে।'
আরও পড়ুন-কপি ছিঁড়ে প্রতিবাদ… TMCর বিস্ফোরক অভিযোগ হেনস্তা ঘিরে! শাহের পেশ করা বিল জেপিসি-তে
অন্যদিকে বিজেপির দাবি, এই বিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি কার্যকর পদক্ষেপ। তারা বলছে, দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্তরা যাতে ক্ষমতায় থেকে প্রমাণ লোপাট বা প্রভাব বিস্তার করতে না পারে, সেই লক্ষ্যে এই আইন প্রয়োজনীয়। বিজেপির কর্ণাটকের বিধায়ক অরবিন্দ বেল্লাড বলেন, 'বিগত সময়ে অনেক মুখ্যমন্ত্রী জেলে থেকেও সরকার চালানোর চেষ্টা করেছেন। এমন পরিস্থিতি থেকে বের হতে হলে শক্তিশালী আইন দরকার। এই বিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের জিরো টলারেন্স নীতির প্রতিফলন।'বর্তমানে ভারতের জনপ্রতিনিধিত্ব আইন অনুযায়ী, কোন সাংসদ বা বিধায়ক যদি এমন অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হন যার শাস্তি কমপক্ষে দুই বছরের কারাদণ্ড, তবে তিনি তার পদ হারান। কিন্তু বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার পদে থাকা নিয়ে কোন বাধা নেই। প্রস্তাবিত নতুন আইনে এই ব্যতিক্রম তুলে দিয়ে শুধুমাত্র গ্রেফতার এবং ৩০ দিন জেলেই পদচ্যুতি ঘটানোর কথা বলা হয়েছে।