‘বাংলা আকাদেমি বাঙালি জাতিসত্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের প্রতীক৷’ এটি বাংলা আকাদেমির নিজস্ব শ্লোগান৷ তাদের এই শ্লোগানটি আমাকে দারুণভাবে বিভ্রান্ত করে৷ বাঙালি জাতিসত্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষ—বলতে আসলে ঠিক কী বোঝায়, সেটা আমি নানাভাবে বোঝার চেষ্টা করেছি৷ যতটুকু বুঝেছি, তার সঙ্গে বাংলা আকাদেমির কর্মকাণ্ডের মিল খুঁজতে গিয়ে বারবারই বিভ্রান্ত হয়েছি৷বাংলা আকাদেমির সঙ্গে আমার সম্পর্ক অনেক বছরের, পুরো চার দশকের৷ এ সম্পর্ক অবশ্য একপক্ষীয়, আমার কাছে বাংলা আকাদেমি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান৷ সেই যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র হিসাবে পড়তে এলাম, প্রায় প্রতিদিনই ফজলুল হক হল থেকে হেঁটে হেঁটে আকাদেমির সামনে দিয়ে কলাভবনে ক্লাস করতে যেতাম৷ ফজলুল হক হল বা শহীদুল্লাহ হলে সাধারণত সায়েন্সের ছাত্ররা থাকত৷ আর্টসের ছাত্র হয়েও কেন আমি এত দূরে থাকতাম, সেটা অবশ্য অন্য প্রসঙ্গ৷ তবে এতটা পথ হেঁটে যেতে আমার মোটেই ক্লান্ত লাগতো না৷ বাংলা আকাদেমি, পরমাণু শক্তি কমিশন, টিএসসি—এ তিনটি স্থাপনাই আমার খুব প্রিয় ছিল৷ বাংলা আকাদেমির ভবনগুলো তখন এখনকার মতো ছিল না৷ মাঝের পুকুরটিকে কেন্দ্র করে অনেক গাছগাছালি ছিল৷ প্রচুর সবুজের মধ্যে ঐতিহ্যমন্ডিত গোটা কয়েক ভবন৷ ভেতরে ঢুকলে মনটা কেমন মুক্ত হয়ে যেতো, মনে হতো যেন একটা বন্ধনহীন পরিবেশ৷ মুক্ত বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ যেন৷স্মৃতিচারণ যখন করছি-ই, আরও একটা বলে নিই৷ প্রতি বছর ফেব্রুয়ারিতে যখন বই মেলা হতো, আকাদেমির চেহারা যেন পাল্টে যেত৷ তখন পুরো আসরটিই বসত আকাদেমির চৌহদ্দির ভেতরে৷ পুকুরের চারদিকে স্টল থাকত, খোলা জায়গায় বড় প্যান্ডেল টানিয়ে নিয়মিত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হতো৷ ছাত্র জীবনে হাতে তেমন অর্থকড়ি থাকত না, তাই বছরের মাঝামাঝি থেকেই মেলার জন্য টাকা জমাতে শুরু করতাম৷তখন এতকিছু বুঝতাম না, হয়তো তাই মাঝেমধ্যে ওই রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে ভাবতাম— বইমেলা আয়োজন করা ছাড়া বাংলা আকাদেমির আর কি কোনো কাজ আছে? এরপর অনেকগুলো বছর পার হয়ে গেছে, সাংবাদিকতা করতে যেয়ে বহুবার আকাদেমির অনেক অনুষ্ঠান কাভার করেছি, প্রতিবারই মনে হয়েছে—বছরে একটা বই মেলা ছাড়া এরা আসলে আর কী করে? এই প্রশ্নটি একবার আমার এক সহকর্মী, যিনি আবার এই প্রতিষ্ঠানের একজন সদস্যও বটে, তাকে করেছিলাম৷ তিনি সাহিত্যের মানুষ, কবি হিসাবেও বেশ নামডাক আছে, আমাকে বললেন— ‘আকাদেমি আসলে গবেষণাধর্মী অনেক কাজ করে৷ তাদের সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে একটা হচ্ছে বইমেলার আয়োজন করা৷’ গুরুত্বপূর্ণ কাজের ফিরিস্তি দিতে যেয়ে বললেন, বুদ্ধিবৃত্তিক নতুন নতুন দ্বারের উন্মোচন তো এখান থেকেই হয়৷ তিনি ৫২ সালের কথা বললেন, ভাষা আন্দোলনের কথা বললেন৷ ভাষা আন্দোলনের সেই চেতনা স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপান্তরিত হওয়ার ক্ষেত্রেও যে এই বাংলা আকাদেমির বিশাল এক ভূমিকা ছিল—সেসব কথাও শোনালেন৷ আমি শুনলাম, কিন্তু ওনার উচ্চারিত কথাগুলোর সঙ্গে এত বছরের পেশাগত অভিজ্ঞতা যখন মিলানোর চেষ্টা করলাম, কিছুটা বিভ্রান্ত হলাম৷পরে অবশ্য আকাদেমির আরও একটা কাজ আমার সামনে দৃশ্যমান হল৷ সেটা হচ্ছে—প্রতিবছর একটা পুরস্কার দেওয়া৷ সাহিত্য ও গবেষণার বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য প্রতিবছর এই ‘বাংলা আকাদেমি পুরস্কার' দেওয়া হয়৷ ততদিনে আমি পুরোদস্তুর সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত৷ তাই টুকটাক খবর টবর রাখি৷ তাই যতই দিন যেতে থাকল, প্রতিবছর পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম দেখতে থাকলাম, ততই বাড়তে থাকল হতাশা আর বিরক্তি৷ বুঝতে পারলাম—এই পুরস্কারগুলো আসলে দেওয়া হচ্ছে সরকার ও সরকারি দলের কোটারিভূক্ত ব্যক্তিদেরকেই৷ এখানে সাহিত্য বা গবেষণার মান গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মোসাহেবী ও চাটুকারিতার প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হওয়া৷এখন একটু বর্তমানে আসি৷ ফেব্রুয়ারি মাস ঘনিয়ে এসেছে৷ আর কদিন পরই শুরু হবে একুশের গ্রন্থমেলা৷ মেলায় নতুন নতুন কী বই আনা যায়, স্টল বা প্যাভেলিয়ন কীভাবে সাজানো হবে, সে সব নিয়ে প্রকাশকরা এখন ব্যস্ত৷ এমনই সময় জানা গেল ‘আদর্শ প্রকাশনী’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে স্টল বরাদ্দ দিচ্ছে না একাডেমি৷ কারণ হিসাবে বাংলা আকাদেমি বলেছে, এই প্রকাশনীর একটি বই বইমেলার নীতিমালা ও নিয়মাবলির ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদের উপ-অনুচ্ছেদ ১৪.১৪ ও ১৪.১৫-এ বর্ণিত শর্তাবলি পূরণে সক্ষম হয়নি৷ তারা বিষয়টি নিয়ে প্রকাশকের সঙ্গে কথা বলেছে৷ জানিয়েছে- ওই বইটি বাদ দিলে তারা স্টল বরাদ্দ পেতে পারে৷ কিন্তু প্রকাশক ওই শর্তে রাজী হয়নি৷এখন প্রশ্ন হচ্ছে ওই ধারা দুটিতে কী আছে? ১৪.১৪ অনুচ্ছেদটি বেশ বড়৷ তবে তার মধ্যে মোটা দাগে যা বলা হয়েছে তা হচ্ছে- অশ্লীল, রুচিগর্হিত, জাতীয় নেতৃবৃন্দের প্রতি কটাক্ষমূলক, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয় এমন বা জননিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর, বইমেলার পক্ষে ক্ষতিকর, এমন কোনও বই বিক্রি করা যাবে না৷ ১৪.১৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে অমর একুশে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, সামাজিক মূল্যবোধের পরিপন্থি কোনও বিক্রি বা প্রদর্শন করা যাবে না৷এই যে দুটি অনুচ্ছেদ, এখানে যে কথাগুলো বলা হয়েছে, তা কি খুব সুনির্দিষ্ট? অশ্লীল, রুচিগর্হিত- এই শব্দগুলোর কি সার্বজনীন কোনও অর্থ আছে? কোনও বিষয় রুচিগর্হিত কি-না সেটা বিচার করবে কে? আমার কাছে যেটা রুচিহীন, সেটাই হয়তো আর একজনের কাছে রুচিশীল৷ এমনটিতো পৃথিবীর সব জায়গাতেই হয়৷ রুচির কি কোনও সার্বজনীন সংজ্ঞা আছে? আর ‘জাতীয় নেতৃবৃন্দের প্রতি কটাক্ষমূলক’- এরই বা কী অর্থ? জাতীয় নেতৃবৃন্দ কারা? কে এটা নির্ধারণ করবে? কী যোগ্যতা বা বৈশিষ্ট্য থাকলে একজনকে জাতীয় নেতৃবৃন্দ বলা যাবে? এসব আসলে খুবই অস্পষ্ট ও বায়বীয় বিশেষণ৷ আর বিষয়টি যদি স্পষ্টও হতো, তারপরও কিন্তু প্রশ্ন করা যায় যে- সেই জাতীয় নেতৃবৃন্দের প্রতি কটাক্ষমূলক কথা লেখা যাবে না কেন? লেখা কি কেবল তৈলমূলক হতে হবে?অনেকে হয়তো বলতে পারেন, এ ধরনের উদ্ভট ও অপমানজনক নীতিমালা বানায় কারা? অথবা কেন তৈরি করা হয়? এসব প্রশ্নের জবাব মোটেই জটিল নয়৷ এতটুকু বুঝতে কারও কষ্ট হওয়ার কথা নয় যে, সরকার বা সরকারি দলকে তুষ্ট রাখতেই এইসব নীতিমালা তৈরি করা হয়৷ ব্যক্তিত্বহীন মোসাহেবদের এনে এই একাডেমির শীর্ষ পর্যায়ে বসানোই হয় এই উদ্দেশ্যে, যেন তারা এমন সব স্বৈরতান্ত্রিক নিয়ম তৈরি করেন, যার মাধ্যমে যখন তখন যে কোনও বইকে পাঠকের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়া যায়৷ কিন্তু বাস্তবে সেটা কি আসলেই যায়? আমার তো মনে হয় না৷ বরং এতে হিতে বিপরীতই হয়৷অতীতে আমরা দেখেছি, হুমায়ুন আজাদের ‘নারী’, তসলিমা নাসরিনের ‘লজ্জা’ বা ‘ক’ বই কে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল৷ এমন সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বইগুলোকে কিন্তু পাঠকের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা যায়নি৷ বরং উল্টো নিষিদ্ধ করার কারণে সেগুলোর বিক্রি আরও বেড়ে গিয়েছিল৷ এবারও যে সেই একই ঘটনা ঘটছে তা এরই মধ্যে বোঝা যাচ্ছে৷ ফাহাম আব্দুস সালামের ‘বাঙালির মিডিয়োক্রিটির সন্ধানে’ বইটি এরই মধ্যে প্রচুর বিক্রি হচ্ছে৷ মেলা শুরুর আগেই আজিজ মার্কেটের বইয়ের দোকানে বা অনলাইনে এই বইটি প্রচুর যাচ্ছে৷ বাংলা আকাদেমি কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে এই একটি বইয়ের বিষয়ে আপত্তির কথা জানালেও, আদর্শ প্রকাশনীর পক্ষ থেকে কিন্তু বলা হচ্ছে তিনটি বইয়ের কথা৷ তার বলছে আকাদেমির লোকজন নাকি তাদের আরও দুটি বইয়ের বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে৷ ওই বই দুটি হচ্ছে ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যবের ‘অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবনীয় কথামালা’, ও জিয়া হাসানের ‘উন্নয়ন বিভ্রম৷’ আপত্তির তালিকায় এই দুটি বইয়ের নামও নিয়ে আসার পেছনে প্রকাশকের বিশেষ কোনও ব্যবসায়িক বুদ্ধি কাজ করছে কি-না বলা কঠিন৷ তবে ফাহাম আবদুস সালামের বইটি পুরো পড়ার সুযোগ না হলেও অপর দুটি বইয়ে চোখ বুলানোর সুযোগ আমার হয়েছে৷ আকাদেমির পক্ষ থেকে যে সকল অজুহাত দেওয়া হয়েছে, নীতিমালায় যেসকল উদ্ভট শর্ত আছে, সেসবের জোরে কিন্তু সহজেই এই দুটি বই নিয়েও আপত্তি করা যায়৷ সে তুলনায় বরং ফাহাম আবদুস সালামের বইটিকে আমার কাছে অনেকটাই আবেগাশ্রিত, কম যুক্তিসম্পন্ন, এবং কখনও কখনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত লেখা বলে মনে হয়েছে৷ তারপরও খড়গ এটির ওপরই কেন নেমে এল? কারণটিও কি তাহলে রাজনৈতিক? কে একজন জানালো এই ভদ্রলোক নাকি বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতার মেয়ের জামাই৷ তাহলে কি এটাই মূল কারণ? আবার একজন জানালেন, মি. ফাহাম নাকি জন্মগতভাবে বিহারি৷ আমাদের এখানে আটকে পড়া অনেক বিহারিই আছেন৷ তারা যদি বাংলাদেশে থাকতে পারেন, তাহলে কি বাংলায় লিখতে পারবেন না? এটা কেমন কথা!আমার বিবেচনায় কোনও বইকে বিবেচনা করতে হবে তার লেখা বা বিষয়বস্তু দিয়ে, লেখক দিয়ে নয়৷ সেই বিচারের ভিত্তিতে বইটিকে আপনি পছন্দ বা অপছন্দ করতে পারেন৷ বই নিয়ে বিতর্ক করতে পারেন৷ কিন্তু কোনও বইকে আপনি নিষিদ্ধ করবেন কোন অধিকারে? অথবা বাজারজাতে বাধাই বা দেবেন কোন রুচিতে? এই যে কাউকে কথা বলতে না দেওয়া, পাঠকের কাছ থেকে বইটিকে ছিনিয়ে নেওয়া- এটাকে আর যাই বলা যাক না কেন গণতান্ত্রিক আচরণ বলা যায় না৷ আপনার বিরুদ্ধচারণ করলেই তার গলা টিপে ধরার যে মানসিকতা একেই বোধকরি ফ্যাসিজম বলা যায়৷বাংলা আকাদেমির বর্তমান মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা একজন কবি৷ আজ থেকে চার দশক আগে, আমি যখন ছাত্র, তখন থেকেই আমি তাঁর কবিতার একজন ভক্ত পাঠক৷ তাঁর কবিতাগুলোতে প্রতিবাদ ও দ্রোহের কথা প্রায়ই দেখেছি৷ এমন একজন মানুষ যখন আকাদেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পেলেন, আমি খুবই আশাবাদী হয়েছিলাম৷ ভেবেছিলাম- আমরা বোধকরি এখন আকাদেমির নতুন একটা চেহারা দেখতে পাব৷ কিন্তু এ কি দেখলাম! উনি তার পূর্বসূরীদের গতানুগতিক পথে তো থাকলেনই, সেই সঙ্গে একহাত বেশিই দেখালেন৷ যে বইকে রাষ্ট্র নিষিদ্ধ করেনি, যে বই দেশের সর্বত্র প্রদর্শিত হতে পারছে, বিক্রি করা যাচ্ছে, সেটিই আনা যাচ্ছে না মেলাতে! কী আশ্চর্য! আগে জানতাম, প্রথাবিরুদ্ধ চিন্তার উর্বর ক্ষেত্র হচ্ছে বাংলা আকাদেমি৷ সেই পাকিস্তান আমল থেকেই প্রতিষ্ঠানটি এমন ভূমিকা দেখিয়েছে৷ আর এখন স্বাধীন দেশের আকাদেমি দেখাচ্ছে বিপরীত আচরণ৷ এখন সারা দেশে যা করা যায়, আকাদেমির আয়োজনে তা হয়ে যায় ব্রাত্য৷শুরুতে বলেছিলাম আমার বিস্ময়ের কথা৷ বলেছিলাম- বইমেলা আয়োজন ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে পুরস্কার প্রদান ছাড়া আকাদেমির আর কোনও কাজ আমার চোখে পড়েনি৷ এখন বরং আরও একটা বিষয় দেখছি৷ সেটা হচ্ছে—নানা ছুতানাতায় মুক্ত চিন্তাকে গলা টিপে ধরার নির্লজ্জ একটা যোগ্যতাও এদের রয়েছে! সামনে আরও কত কী দেখতে হবে—কে জানে৷