ফেসবুকে একটি কথিত পোস্টকে কেন্দ্র করে রংপুরে হিন্দুদের উপরে হামলার ঘটনার পর সেখানে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে৷ এদিকে, হামলায় ক্ষতিগ্রস্তরা খোলা আকাশের নীচে জীবনযাপন করছেন৷
রংপুরের পীরগঞ্জ রামনাথপুর ইউনিয়নের তিনটি গ্রামে হামলাকারীদের দেওয়া আগুনে পুড়ে গিয়েছে হিন্দুদের ২৫টি ঘরবাড়ি৷ মন্দির ভাঙচুর-সহ ঘরবাড়ি-দোকানপাট লুটপাট করা হয়েছে৷ এক রাতেই নিঃস্ব হয়ে গিয়েছে অনেকগুলো পরিবার৷ উচ্ছৃঙ্খল জনতার হামলায় ক্ষতিগ্রস্তরা খোলা আকাশের নিচে জীবন করছেন৷
কথিত ফেসবুক পোস্টকে ঘিরে উত্তেজনা
পুলিশ এবং স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, রংপুরের রামনাথপুর ইউনিয়নের মাঝিপাড়ার এক হিন্দু কিশোর রবিবার ইসলাম ধর্মকে ‘অবমাননা করে’ ফেসবুকে একটি ছবি পোস্ট করেছে বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে৷ এরপর কয়েকশত মানুষ সেই কিশোরের বাড়ি ঘেরাও করে৷ তবে তার আগেই সেই বাড়ির সদস্যরা অন্যত্র সরে যান৷
সেইসময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পীরগঞ্জ থানার পুলিশ সদস্যরা এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সেই বাড়িতে যান৷ পুলিশ তখন পুরো বাড়ি ঘেরাও করে স্থানীয়দের বুঝিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করে৷ কিন্তু সেই উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মাঝেই রবিবার রাত ১০টায় ইউনিয়নটির হিন্দু অধ্যুষিত বড় করিমপুর, কসবা ও উত্তরপাড়া এলাকায় ঘরবাড়ি, দোকানপাট, মন্দিরে ভাঙুচুর ও লুটপাট করে একদল উচ্ছৃঙ্খল জনতা৷ তারা ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে পালিয়ে যায়৷
হামলার সময় স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের কৃষক, মৎস্যজীবী ও দিনমজুর মানুষজন প্রাণ রক্ষায় ঘর থেকে পালিয়ে যায়৷ তারা অভিযোগ করেন, দুর্বৃত্তরা হিন্দু বাড়িগুলো থেকে টাকা, গয়না, গবাদিপশু লুটপাট করেছে৷ শেষে পেট্রোল ঢেলে ঘরবাড়িগুলোতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে৷
পরিকল্পিত আক্রমণ, বলছে পুলিশ
হিন্দু কিশোরের বাড়ির পার্শ্ববর্তী গ্রামে অগ্নিসংযোগের খবর পেয়ে পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছায়৷ কিন্তু ততক্ষণে বেশ কয়েকটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে উত্তেজিত জনতা৷ এই সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ১০ রাউন্ড টিয়ার সেল ও ৬১ রাউন্ড শটগানের গুলি ছোড়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা৷
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা পুলিশ সুপার বিপ্লব কুমার সরকার মনে করেন, সুপরিকল্পিতভাবে হিন্দুদের উপর হামলা চালানো হয়েছে৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘ফেসবুকে ধিক্কারজনক একটি পোস্টকে কেন্দ্র করে পরবর্তীতে তিনটি গ্রামে নৃশংস ধ্বংসলীলা চালানো হয়েছে৷ অসংখ্য দুষ্কৃতী নাশকতা চালিয়েছেন৷ নিরীহ মানুষের উপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়েছে৷' তিনি বলেন, ‘রবিবার রাতে প্রায় ৩০০ মানুষ মাঝিপাড়ায় সমবেত হয়েছিল৷ তারা মুহূর্তের মধ্যে গ্রামে পেট্রল ঢেলে অগ্নিসংযোগ করেছে৷ তাৎক্ষণিকভাবে পেট্রল ছিটিয়ে অগ্নিসংযোগের ঘটনাটি আমরা মনে করছি সুপরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে৷’ এদিকে, হিন্দুদের বাড়িতে হামলার ঘটনার পর পুলিশ অন্তত ৪২ জনকে গ্রেফতার করেছে৷ ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে৷
পুড়ে ছাই ঘরবাড়ি, সম্পদ: সর্বস্বহারাদের কান্নার রোল
হিন্দু বাড়িতে হামলার ঘটনায় পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে অনেকের শখের ঘরবাড়ি, খড়ের গাদা, গবাদি পশু৷ কারও কারও ঘরের সকল আসবাবপত্র, কাপড়ও পুড়ে গিয়েছে৷ টাকা-সোনার গয়না হারিয়ে একেবারে নিঃস্ব বড় করিমপুর, কসবা ও উত্তরপাড়ার ২৫টি বাড়ির প্রায় ৬৬টি পরিবার৷ খোলা আকাশের নীচে জীবনযাপন করছেন তাঁরা৷
রাতের দুঃসহ স্মৃতি মনে পড়তেই কান্নায় ভেঙে পড়ছেন অনেকে৷ কান্নাজড়িত কণ্ঠে বড় করিমপুরের কৃষক ননীগোপাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘আমি চার সন্তান নিয়ে বাড়িতে বসবাস করি৷ রবিবার রাত ৮টায় শুনতে পেলাম পাশের গ্রামে একটি হিন্দুবাড়ির খড়ের গাদায় আগুন দেওয়া হয়েছে৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি, পুলিশ, চেয়ারম্যান গাড়িতে করে ছুটে যান সেখানে৷ সেখানে হাজার-হাজার মানুষ জমায়েত হয়৷ পুলিশ যাওয়ার পর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়৷’ তিনি বলেন, এরপর শত শত মানুষ আমাদের গ্রামে এসে একটি বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়৷ আমার পার্শ্ববর্তী একটি বাড়িতে আগুন দেয়৷’ ৫৫ বছরের গোপাল বলেন, ‘আমি প্রাণভয়ে আমার ছোটো ভাইয়ের বাড়িতে পালিয়ে যাই৷ দূর থেকে দেখেছি আমার বাড়িতে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে৷ ঠেকানোর মত উপায় নেই৷’তিনি বলেন, ‘এখন আমার আর কিছুই নেই৷ খাবার নেই, কাপড় নেই৷ কি দোষ করেছিলাম আমরা?’
উজালী রানি নামে ভুক্তভোগী এক মহিলা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘আগুনে আমার সব পুড়ে গিয়েছে৷ এর ক্ষতিপূরণ সরকারও দিতে পারবে না৷ আমি এর বিচার চাই৷’ সরলা রায় নামের অপর এক হিন্দু মহিলা রবিবার রাতের কথা স্মরণ করে জানান যে একদল মানুষ তাদের গ্রামে এসে হিন্দু বাড়ি পুড়িয়ে ফেলতে বলে৷ ৪৩ বছরের এই গৃহিনী বলেন, ‘‘আমি এই কথা শুনে গোয়াল থেকে গরু বের করে ঘর থেকে পালিয়ে যাই৷ ওরা আমার ঘরে ঢুকে আমার মেয়ের বিয়ের জন্য রাখা ৫০ হাজার টাকা, সোনার গয়না - সব কিছু নিয়ে গিয়েছে৷ আমার ঘর নেই, টাকা নেই, আমি কি নিয়ে থাকব?’
পুলিশের সতকর্তার মাঝে হামলা
এদিকে, রংপুর রেঞ্জ ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য দাবি করেছেন, প্রশাসন সতর্ক থাকায় হামলাকারীরা বড় কোনও ক্ষতি করতে পারেনি৷ তিনি বলেন, ‘দুর্গাপুজোয় বিভিন্ন স্থানে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটায় আমরা সর্বোচ্চ সতর্ক ছিলাম৷ তাই আরও বড় ধরনের ঘটনা ঘটাতে পারেনি দুষ্কৃতীরা৷’
রংপুরে হিন্দুদের উপর হামলার ঘটনায় ইতিমধ্যে একটি মামলা হয়েছে৷ আরেও মামলা হবে কিনা, তা নিশ্চিত করতে পারেনি পুলিশ৷ আর ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ করেছেন স্থানীয় রাজনীতিবিদরা৷
(বিশেষ দ্রষ্টব্য : প্রতিবেদনটি ডয়চে ভেলে থেকে নেওয়া হয়েছে। সেই প্রতিবেদনই তুলে ধরা হয়েছে।)