কোন সমাধিস্থলের রেকর্ড নেই। কোন সমাধি ফলক নেই। কোন স্মৃতিস্তম্ভও নেই। সালটা ২০১৪। ইতিহাসবিদ ক্যাথরিন করলিস পুরনো মানচিত্র, সরকারি নথি ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে বেশ কিছু সমীক্ষা করছিলেন। সেই কাজ করতে করতে হঠাৎই নজরে আসে গোপন সমাধি ক্ষেত্র। তখন ইতিহাসবিদের মনে প্রশ্ন ওঠে এটি তাহলে কীসের সমাধি? আর সেই খোঁজ করতেই উঠে আসে আয়ারল্যান্ডের গলওয়ের তুয়াম শহরে প্রাক্তন সেন্ট মেরিজ শিশু আশ্রমের (মাদার্স অ্যান্ড বেবি হোম) স্থানে গণকবর।
সূত্রের খবর, বছরের পর বছর ধরে সেখানে অন্তত আটশ শিশুকে স্রেফ সেপটিক ট্যাঙ্কে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে। ১৯২৫ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত বন সিকোর্স সিস্টার্স ওই বেবি হোম পরিচালনা করেন। ৮০ বছর আগে মেরি মার্গারেট সেখানেই মারা যান। বারে বারে এই হোম নিয়ে নানা অভিযোগ, ধোঁয়াশার কথা উঠে এসেছে।এই গণকবরের প্রথম সন্ধান পান শৌখিন ইতিহাসবিদ ক্যাথরিন করলিসই। সোমবার থেকে এই জায়গায় আনুষ্ঠানিক খননকাজ শুরু হচ্ছে। প্রায় দুই বছর ধরে খনন চলবে বলে মনে করা হচ্ছে। সেখানে শিশুদের একটি খেলার মাঠের পাশের ঘাসের বর্গাকার জায়গায় নামানো হয়েছে খননযন্ত্র। আর এই সমাধিই আয়ারল্যান্ডের ইতিহাসের সবচেয়ে করুণ এক অধ্যায়ের সাক্ষী হয়ে গেল বিশ্বের সামনে।
আরও পড়ুন-আরও বিপাকে সন্দীপ ঘোষ! আরজি কর দুর্নীতি মামলার চার্জ গঠন, আরও ৪ জনের নাম আছে
২০১৪ সালেই জানা যায়, সে দেশের তুয়াম শহরের একটি পুরনো শিশু হোমের নিচে শত শত শিশুকে গণকবর দেওয়া হয়। একটি তালিকায় ৭৯৬ জনের মৃত্যুর বিষয় নথিভুক্ত থাকলেও তাদের কবরের সুনির্দিষ্ট তথ্য ছিল না।ইতিহাসবিদ একটি লেখাতে জানিয়েছিলেন, ওই স্থানে আগে একটি সুয়ারেজ ছিল, যা ১৯৩৭ সালের পর বন্ধ হয়ে যায়। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে দুই শিশু সেখানে খেলার সময় একটি কংক্রিট স্ল্যাব সরিয়ে হাড় দেখতে পায়। ক্যাথরিনের সংগ্রহ করা মৃত্যু তালিকায় ৭৯৬ শিশুর নাম থাকলেও তাদের কারো কবরের খোঁজ মেলেনি।
এই ঘটনা আরও প্রকাশ্যে আসে, এক মহিলার জোর দাবিতে। তিনি জানিয়েছিলেন, বহু বছর আগে ওই হোম থেকে জানানো হয় তাঁর সদ্যোজাত বোনের মৃত্যু হয়েছে। তারপর আর কোনও খোঁজ দেওয়া হয়নি। তাঁর এক মাত্র ইচ্ছে বোনকে সমাধিস্থ করার, পূর্ণ মর্যাদার সঙ্গে।এরপরেই শুরু হয় প্রায় আট দশক আগে মারা যাওয়া বোনের খোঁজ। পাশাপাশি ম্যানচেস্টারের বাসিন্দা, ৭১ বছর বয়সী অ্যানেট ম্যাককে ছোটবেলা থেকেই জানতেন যে, তাঁর এক বড় বোন একেবারে শিশু অবস্থায় মারা গিয়েছে। সেই তথ্যের বিস্তারিত খোঁজে এসে তাকে এই সত্যের মুখোমুখি হতে হবে তিনি ভাবতে পারেননি। তিনি তার আগে পর্যন্ত কোনওভাবেই জানতেন না, সন্ন্যাসিনীরা তার বড় বোনকে গণকবরে সমাহিত করেছেন।
সানডে টাইমস জানিয়েছে, ২০১২ সালে স্থানীয় ইতিহাসচর্চার অংশ হিসেবে করলেস দাবি করেছিলেন, তুয়ামে ১৯২৫ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত পরিচালিত সেই ক্যাথলিক হোমে মারা যাওয়া ৭৯৬ শিশুর কোনও কবরের রেকর্ড নেই। তিনি মনে করছেন, ১৯৭৫ সালে ওই হোমের পুরোনো যে সেপটিক ট্যাঙ্কে দুই শিশুর দেহাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছিল, হয়তো সেখানে বাকিদের দেহাবশেষও রয়েছে।প্রকাশিত রিপোর্টে খবর, সরকার স্বীকার করেছে এমন ৯ হাজার শিশুর মৃত্যু ঘটেছে আয়ারল্যান্ডের বিভিন্ন মাদার অ্যান্ড বেবি হোমে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে অবিবাহিত মা ও তাঁদের সন্তানদের রাখা হতো। কিন্তু ধর্মীয়, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তাদের ওপর নানা ধরনের নিপীড়নও চালানো হত।
আরও পড়ুন-আরও বিপাকে সন্দীপ ঘোষ! আরজি কর দুর্নীতি মামলার চার্জ গঠন, আরও ৪ জনের নাম আছে
এই প্রসঙ্গেই সামনে এসেছে সেখানকার সমাজব্যবস্থার আরও একটি সত্যি। সিএনএন জানিয়েছে, বিংশ শতাব্দীর বেশিরভাগ সময় ধরে টুয়ামের এই প্রতিষ্ঠানটিতে এমন মহিলাদের পাঠানো হতো, যারা বিবাহ বর্হিভূত সম্পর্কের কারণে গর্ভবতী হয়ে পড়েছে। তাদেরকে গোপনে সন্তান জন্মদানের জন্য এখানে পাঠানো হত।১৯২২ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ক্যাথলিক চার্চ এবং আয়ারল্যান্ড সরকার অবিবাহিত মহিলাদের শাস্তি দিতে এমন বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছিল। এসব প্রতিষ্ঠানের চারপাশ উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা থাকতো। এসব ভবনে জন্মের পর প্রায়ই জোর করে মায়ের কাছ থেকে শিশুদের কেড়ে নেওয়া হত। মায়েরা কখনও জানতেই পারতেন না কী হয়েছে সে সব শিশুর সঙ্গে। জানা যায়, বহু শিশুকে মেরে ফেলা হত। কাউকে কাউকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় অন্য দেশে।