শেখ হাসিনা উৎখাতের পর থেকেই গভীর সংকটে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, টেক্সটাইল ও নিট পোশাক খাত। শিল্প মালিকরা বলছেন, জ্বালানির সংকট, শ্রমিক অসন্তোষ ও ব্যাঙ্ক খাতের অস্থিতিশীলতা এই খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। গত এক বছরে শুধুমাত্র বাংলাদেশের গাজীপুরে ৭২টি কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। যার জেরে কর্মহীন হয়ে পড়েছে ৭৩ হাজার শ্রমিক। এমনটাই দাবি করা হয়েছে এক রিপোর্টে।
গাজীপুর মহানগরে টঙ্গীর খাঁ পাড়া সড়কে সিজন ড্রেসেস কারখানায় কাজ করতেন ১,২৬০ জন কর্মী। ২০২২ সালে এই সংস্থা থেকে ৩ কোটি ৩৭ লক্ষ ডলারের পোশাক রপ্তানি করা হয়েছিল। কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের জেরে সংস্থায় প্রথম মন্দার ধাক্কা লাগে ২০২৩ সালে। ওই বছরের অক্টোবর থেকে পরের বছরের মার্চ পর্যন্ত কারখানায় তেমন কাজই ছিল না।কিন্তু শ্রমিকদের ছাঁটাই না করে কর্তৃপক্ষ সাব-কন্ট্রাক্টে কিছু কাজ করে কারখানা চালু রাখার চেষ্টা করে।কিন্তু ২০২৪ সালের এপ্রিল থেকে অসংখ্য কার্যাদেশ আসতে থাকলেও অসহযোগিতা শুরু করে সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ। ৮ শতাংশের পরিবর্তে ঋণের কিস্তি দ্বিগুণ হারে কেটে নেওয়া শুরু করে ব্যাঙ্কগুলি।যার জেরে শ্রমিক মজুরি, গ্যাস-বিদ্যুত্ বিল-সহ কারখানা পরিচালনার ব্যয় নির্বাহে তীব্র সংকটে পড়ে সংস্থাটি। বকেয়া ও দেনা বাড়তে থাকলে কারখানায় শ্রমিকরা বিক্ষোভ শুরু করেন। শ্রমিক অসন্তোষের কারণে ৪০ কোটি টাকার কার্যাদেশ বাতিল করে দেয় বিদেশি ক্রেতা।বাধ্য হয়ে গত জুলাইয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয় ‘সিজন ড্রেসেস’। যার জেরে কর্মহীন হয়ে পড়েন কারখানার শ্রমিক-কর্মচারীরা।
আরও পড়ুন-ভারতের 'মারণাস্ত্র'-এ আগ্রহী ফিলিপিন্স! দক্ষিণ চিন সাগরে নতুন সমীকরণ
কলকারখানা ও পরিদর্শন অধিদপ্তর এবং শিল্প পুলিশ সূত্রে খবর, শুধু এই সংস্থা নয়, গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে গত ২৯ জুলাই পর্যন্ত গাজীপুরের ৭২টি কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এরমধ্যে ছয় মাসেই বন্ধ হয়েছে ২৯টি। বন্ধ কারখানাগুলোর মধ্যে রয়েছে বেক্সিমকোর ১৩টি-সহ মাহমুদ জিন্স, ডার্ড কম্পোজিট, পলিকন লিমিটেড, টেক্সটিল ফ্যাশন, ক্লাসিক ফ্যাশন, লা-মুনি অ্যাপারেলস-সহ বিজিএমইএভুক্ত বড় ২০ প্রতিষ্ঠানও। প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, কারখানা বন্ধ হওয়ায় জেলায় বেকার হয়েছেন প্রায় ৭৩ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী। তাঁদের অনেকে কাজ না পেয়ে পেশা পরিবর্তন করেছেন। জানা গেছে, গত জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে বন্ধ হয়ে গেছে গাজীপুর মহানগরীর গাছার আরকেএম অ্যাপারেলস কারখানা। যার জেরে চাকরি হারিয়েছেন ২৬০ শ্রমিক।অন্যদিকে, গত ফেব্রুয়ারিতে অর্থাভাবে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয় রপ্তানিমুখী বেক্সিমকো গ্রুপের ১৩টি পোশাক কারখানা। ফলে কাজ হারান কারখানার ২৮ হাজার ৫১৩ জন শ্রমিক। কারখানা খুলে দেওয়ার দাবিতে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভও করেছেন শ্রমিকরা।
এই আবহে জাতীয় গার্মেন্ট শ্রমিক জোট বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আশরাফুজ্জামান বলেন, চাকরি হারানো শ্রমিকদের খুব কমই অন্য কারখানায় কাজ পেয়েছেন। প্রায় সব কারখানায় কার্যাদেশ কমে গেছে। নতুন নিয়োগ নেই বললেই চলে। তাছাড়া প্রতিনিয়তই নতুন করে শ্রমিক ছাঁটাই করা হচ্ছে। বেকার পোশাক শ্রমিকরা চাকরি ছেড়ে অটোরিকশা, ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনা-সহ বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হয়েছেন। মহিলা শ্রমিকদের মধ্যেও অনেকে অন্যত্র গিয়ে পোশাক কারখানায় চাকরি করছেন। অনেকে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন। আবার অনেকে গাজীপুরে থেকে টেইলারিং, পোশাকের দোকান-সহ বিভিন্ন পেশার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। সব মিলিয়ে গাজীপুরে শ্রমিকপল্লীতে চলছে হাহাকার।
আরও পড়ুন-ভারতের 'মারণাস্ত্র'-এ আগ্রহী ফিলিপিন্স! দক্ষিণ চিন সাগরে নতুন সমীকরণ
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের গাজীপুর কার্যালয় সূত্রে খবর, গত জানুয়ারিতেই গাজীপুরে ৪৩টি কারখানা বন্ধ হয়েছে । বেক্সিমকোর ১৩টি-সহ বাকি ২৯টি কারখানা বন্ধ করা হয়েছে গত ছয় মাসে। সব মিলিয়ে কাজ হারিয়েছেন ৭৩ হাজার ১০৩ জন শ্রমিক। বন্ধ কারখানাগুলোর বেশির ভাগই কাজ না থাকা, কার্যাদেশ বাতিল এবং আর্থিক সংকটে বন্ধ হয়ে গিয়েছে।গাজীপুর শিল্প পুলিশের পুলিশ সুপার আল মামুন শিকদার বলেন, মালিকানা পরিবর্তন, ব্যাঙ্ক ঋণ রিশিডিউল না করা, কাজ না থাকা ইত্যাদি কারণে কারখানা বন্ধ হচ্ছে। তবে আর্থিক সংকটের কারণেই বন্ধ হচ্ছে বেশির ভাগ কারখানা।