গত কয়েকদিন ধরে দক্ষিণ এশিয়ার স্পর্শকাতর অঞ্চলে সামরিক গতিবিধি বেড়ে গিয়েছে। এর জেরে উদ্বেগ বেড়েছে ভারতে। জানা গিয়েছে, মার্কিন সেনাবাহিনীর ১০০ জনেরও বেশি সেনা বাংলাদেশের চট্টগ্রামে পৌঁছেছে। অন্যদিকে ভারত তার তিন বাহিনীর ১২০ জন সদস্যকে মায়ানমারে পাঠিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব ঘটনা নিছক কাকতালীয় নাও হতে পারে। বিশেষ করে যখন এই দুটি স্থান ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য (সেভেন সিস্টারস) এবং মায়ানমারের অস্থিতিশীল রাখাইন প্রদেশের কাছাকাছি। এগুলো কি যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের অংশ, নাকি আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যে নতুন উত্তেজনা?
বাংলাদেশের চট্টগ্রাম শহরটি বঙ্গোপসাগরের কৌশলগত উপকূলে অবস্থিত। সেখানেই গত এক সপ্তাহ ধরে মার্কিন সামরিক তৎপরতার বেড়েছে। গত ১০ সেপ্টেম্বর মার্কিন বিমান বাহিনীর একটি সি-১৩০ জে সুপার হারকিউলিস বিমান শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেছিল। এরই সঙ্গে জানা গিয়েছে, প্রায় ১২০ জন মার্কিন সেনা এবং বিমান বাহিনীর কর্মকর্তা চট্টগ্রামে পৌঁছেছেন। এসব সৈন্যরা রেডিসন ব্লু হোটেলে অবস্থান করে, যেখানে তাদের নাম রেজিস্টারে লেখা হয়নি। এই অপারেশনটি 'অপারেশন প্যাসিফিক অ্যাঞ্জেল ২৫-৪'-এর অংশ। ১৫ থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কার বিমান বাহিনীর মধ্যে পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এই মহড়ার বিষয়টি গোপন রাখার চেষ্টা হয়েছিলল?
এর আগে, ৮-১০ সেপ্টেম্বর হাওয়াইতে অনুষ্ঠিত 'ল্যান্ড ফোর্সেস টকস'-এ ইউএস আর্মি প্যাসিফিক কমান্ড এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার করার বিষয়ে আলোচনা করেছিল। এদিকে বঙ্গোপসাগরে চট্টগ্রামের অবস্থান তাৎপর্যপূর্ণ। সেখানে চিনের প্রভাব বাড়ছে। কিছু প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র মায়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলিকে (যেমন আরাকান আর্মি) সমর্থন করতে চায়। এই বিদ্রোহীরা জুন্তা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। এদিকে বাংলাদেশের সেন্ট মার্টিন দ্বীপেও আমেরিকার নজর রয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। বাংলাদেশের গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে যে মার্কিন সেনারা ২০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম ত্যাগ করবে।
এদিকে ভারতও নীরবে পাল্টা জবাব দিয়েছে। গত ১৬ সেপ্টেম্বর ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি আইএল-৭৬ বিমান সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমান বাহিনীর ১২০ জন সদস্যকে নিয়ে মায়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে অবতরণ করেছিল। এটি তৃতীয় 'ভারত-মায়ানমার পারস্পরিক সামরিক সাংস্কৃতিক বিনিময়'। ১৬ থেকে ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলবে। এই মহড়ায় অপারেশনাল সহযোগিতা, সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং প্রতিরক্ষা সম্পর্কের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে। মায়ানমারের সামরিক জুন্তার সঙ্গে ভারতের ঐতিহাসিক সম্পর্ক জোরদার করতেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর থেকে প্রতিবেশী দেশের সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় রয়েছে। এদিকে মায়ানমারকে নিজেদের 'অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি'র একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে মনে করে ভারত সরকার। বিশেষ করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির সঙ্গে যোগাযোগের জন্য।
কালাদান মাল্টি-মোডাল ট্রানজিট প্রজেক্ট (মিজোরাম থেকে সিত্তে বন্দর পর্যন্ত) এর মতো প্রকল্পগুলি জুন্তার সমর্থনের উপর নির্ভর করে। কিন্তু মায়ানমারে আরাকান আর্মি ও অন্যান্য বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধ চলছে। এই অর্থে, এই গোটা বিষয়টি খুব সংবেদনশীল। এদিকে এর আগে গত মে মাসেও কক্সবাজারে মার্কিন সেনার উপস্থিতি ঘিরে জল্পনা তৈরি হয়েছিল। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের চট্টগ্রাম থেকে মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশে মানবিক করিডোর তৈরি করার পরিকল্পনা করছিল মহম্মদ ইউনুসের সরকারের। তবে এই করিডোরের মাধ্যমে উত্তরপূর্ব ভারতে অশান্তি ছড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছিল। এদিকে এই করিডোরের মাধ্যমে বাংলাদেশ নিজেদের সার্বভৌমত্বের সঙ্গে আপস করতে পারে বলে আশঙ্কা শুরু হয়েছিল তাদের দেশের অভ্যন্তরেই। যার জেরে রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল ইউনুস সরকারের ওপর। তারপর বেশ কয়েক মাস বিষয়টি নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য করা হয়নি ইউনুস সরকারের তরফ থেকে। এমনকী বলা হয়েছিল, এই করিডোরের বিষয়ে সরকার চূড়ান্ত কোনও সিদ্ধান্তই নেয়নি। উল্লেখ্য, এর আগে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকার সময় দাবি করেছিলেন, আমেরিকা সেন্ট মার্টিন্স দ্বীপে ঘাঁটি গড়তে চায়। এরই সঙ্গে ভারতের উত্তরপূর্বের খ্রিস্টান অধ্যুষিত রাজ্যগুলির সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশ মিলিয়ে একটি খ্রিস্টান দেশ গড়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।