যদিও আত্মহত্যার চেষ্টা এখন আর অপরাধ নয়, তবুও এটিকে আজও লজ্জাজনক হিসেবে দেখা হয়। এখন প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সক্রিয় আলোচনা চলছে। এর ফলে, যারা এর শিকার হন, তাদের সঙ্গে প্রায় অচ্ছুতের মতো ব্যবহার করা হয়। আত্মহত্যা প্রতিরোধ মাসে এই নিয়ে বিশদে কথা বললেন মনসিজ (টেকনো ইন্ডিয়া গ্রুপের একটি মানসিক স্বাস্থ্য ইউনিট)-এর কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট প্রজ্ঞা প্রিয়া মণ্ডল।
আত্মহত্যার ক্রমবর্ধমান হার
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে ৭ লক্ষ ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশ বেড়েছে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (NCRB)-এর ২০২২ সালের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, শুধুমাত্র ভারতেই প্রতি বছর ১৩,০০০-এর বেশি শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুসারে, ভারতে মোট আত্মহত্যার মৃত্যুর ৭.৬ শতাংশ হলো শিক্ষার্থী।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যা
২০২০ সালের একটি গবেষণা অনুযায়ী, ভারতের ৬২ শতাংশ মেডিকেল শিক্ষার্থী এবং ৩৬ শতাংশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার্থী বিষণ্ণতায় ভুগছিল। ন্যাশনাল মেডিকেল কমিশন কর্তৃক ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, গত ৫ বছরে ১২২ জন মেডিকেল শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। প্রকৃত সংখ্যাটি হয়তো এই প্রকাশিত তথ্যের চেয়েও বেশি।
প্রতিরোধ এবং সমাধানের পথ
সত্যি বলতে, আত্মহত্যা প্রতিরোধ একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। এটি শুধুমাত্র ফ্যান লাগানো বন্ধ করে দেওয়ার মতো সমাধান নয়। সম্ভবত, আমাদের মনোযোগ 'আত্মহত্যা প্রতিরোধ' থেকে সরিয়ে 'জীবনের প্রতি ভালোবাসা' বাড়াতে হবে। এক অর্থে, আশাই হলো মৃত্যুর ইচ্ছার বিপরীত। মানসিক সহায়তার একটি পরিবেশ তৈরি করা, কর্তৃপক্ষ এবং অভিভাবকদের বোঝানো যে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ভালো ফল পাওয়ার জন্য লজ্জা বা শাস্তির বদলে উৎসাহ দেওয়া কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তরুণদের প্রয়োজন সম্পর্কে সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি করা এবং আত্মহত্যার ভাবনা ও চেষ্টার সঙ্গে জড়িত সামাজিক কলঙ্ক কমানো খুবই জরুরি। একই সাথে, বুলিং এবং র্যাগিং-এর বিরুদ্ধে কঠোর আইন অবিলম্বে কার্যকর করা প্রয়োজন, কারণ অসংখ্য আত্মহত্যার পেছনে এই কারণগুলো রয়েছে। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং প্রতিষ্ঠান—সবার জন্য ব্যক্তিগত কাউন্সেলিং এবং সচেতনতা কার্যক্রমের মতো মানসিক স্বাস্থ্য উদ্যোগগুলো সক্রিয়ভাবে বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষাগত পাঠ্যসূচির অংশ হিসেবে মানসিক চাপ মোকাবিলার প্রোগ্রাম অন্তর্ভুক্ত করলে শিক্ষার্থীরা ব্যাপকভাবে উপকৃত হতে পারে।
কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আত্মহত্যার কারণ
কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আত্মহত্যার কারণ হিসেবে প্রায়শই শিক্ষাগত চাপ এবং পরীক্ষার খারাপ ফলকে সরলীকরণ করা হয়। এই সরলীকরণের প্রক্রিয়ায় প্রেক্ষাপটটি হারিয়ে যায়। পরিবারের পক্ষ থেকে ক্রমাগত চাপ এবং অবাস্তব প্রত্যাশার বিপদ ছাড়াও, এটি বোঝা প্রয়োজন যে ভালো ফল না করতে পারার সাথে অতিরিক্ত লজ্জা জড়িয়ে আছে, যা উদ্বেগ, মানসিক ক্লান্তি এবং এমনকি এড়িয়ে চলার আচরণের একটি চক্র তৈরি করে। একটি খারাপ ফলকে যেন কলঙ্কিত ব্যক্তিত্ব বা জীবনের বোঝা হিসেবে দেখা হয়। আত্মহত্যাকে এই লজ্জা এবং নেতিবাচকতা এড়ানোর একটি উপায় হিসেবে দেখা যেতে পারে — যেখানে মৃত্যু এবং শূন্যতা আরও বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়। তারা তাদের ক্ষয়িষ্ণু আত্ম-সম্মান এবং বিকৃত প্রতিবিম্ব থেকে মুক্তি পেতে চায়, এবং লজ্জা হলো এমন একটি মারাত্মক হাতিয়ার যা একজন ব্যক্তিকে নিজের জীবন শেষ করে দেওয়ার পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে। উপরন্তু, আত্মহত্যার চেষ্টার সাথেও লজ্জা যুক্ত থাকে, যা তাদের আবার চেষ্টা করতে উৎসাহিত করে, এবং তারা লজ্জা ও তা থেকে পালানোর মরিয়া খোঁজের চক্রে আটকে পড়ে।
পড়াশোনার ফল ছাড়াও, বুলিং হলো এমন একটি বড় উদ্বেগ যা অন্যান্য অনেক কারণের মধ্যে একজনকে আত্মহননের পথে ঠেলে দেয়। পারিবারিক সমস্যা, প্রত্যাখ্যান, আত্ম-সন্দেহ এবং প্রেমের সম্পর্কের ভাঙনও কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আত্মহত্যার চেষ্টার সঙ্গে উল্লেখযোগ্যভাবে জড়িত। কিছু ক্ষেত্রে, আত্মহত্যা প্রায়শই একটি আবেগপ্রবণ কাজও হতে পারে।
সতর্কতার লক্ষণ এবং প্রতিরোধ
এটি প্রায়শই "ইশ, আমি যদি মরে যেতাম" এমন ভাবনা দিয়ে শুরু হয়, এই আশায় যে তারা তাদের চারপাশের মানুষের কাছে আর সমস্যা হয়ে থাকবে না বা তাদের হতাশ করবে না। কিন্তু এই ধরনের চিন্তাভাবনার গভীরে গেলে হতাশা এবং অসহায়ত্বের মারাত্মক অনুভূতিগুলো খুঁজে পাওয়া যায়। কিছু লক্ষণ আছে যা আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, এবং সামাজিক প্রাণী হিসেবে আমাদের এটা নিশ্চিত করা জরুরি যে তারা পুরোপুরি সামাজিক যোগাযোগ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার আগে যখন প্রথমবার সাহায্য চায়, তখন যেন আমরা তাদের পাশে থাকি।
পাঠকদের প্রতি: প্রতিবেদনটি চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে তাঁর মতামতের ভিত্তিতে লেখা হয়েছে। এটি সমস্যাটি সম্পর্কে সাধারণ ধারণার উপর আলোকপাত করা মাত্র। ব্যক্তিবিশেষে প্রতিটি সমস্যার চিকিৎসা এবং নিরাময়ের পদ্ধতি পৃথক। তাই যে কোনও সমস্যায় শুধুমাত্র এই প্রতিবেদনের কথায় ভরসা না রেখে, ব্যক্তিগতভাবে চিকিৎসকের বা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
লাইফলাইন ফাউন্ডেশন সোম-রবি (সকাল ১০টা থেকে সন্ধে ৬টা পর্যন্ত) হেল্পলাইন নম্বর: 033 24637401, 033 24637432
NIBS হেল্পলাইন সোম-শুক্র (সন্ধে ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত) হেল্পলাইন নম্বর: +91-98364 01234, +91-033 2286 5603।