সেটা ছিল ২০০০ সাল, মুক্তি পেয়েছিল ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘বাড়িওয়ালি’। আর সেই ছবিতে 'মালতী'র চরিত্রে মুগ্ধ করেছিলেন অভিনেত্রী সুদীপ্তা চক্রবর্তী। সেটির জন্যই জাতীয় পুরস্কারও পান তিনি। আর এবার বহু বছর পর আরও একবার পরিচারিকা 'হাসি' হয়ে বড় পর্দায় ধরা দিয়েছেন সুদীপ্তা। সৌজন্যে সুদেষ্ণা রায় ও অভিজিৎ গুহর পরিচালনায় তৈরি 'আপিস'। আর সেই ছবি ও চরিত্র নিয়েই Hindustan Times Bangla-র সঙ্গে কথা বললেন সুদীপ্তা চক্রবর্তী।
'বাড়িওয়ালি' ‘মালতী’র পর এবার পরিচারিকা ‘হাসি’র চরিত্রে। এই চরিত্রটিতে নতুন কী পেয়েছেন?
সুদীপ্তা চক্রবর্তী: পুরোটাই আলাদা, শুধু পেশাটা এক। 'বাড়িওয়ালি' তো অনেক বছর আগের ছবি। তবে এখনও 'মালতী'র স্ট্রং একটা ইমেজ মানুষের মনে থেকে গিয়েছে। ওটা ভারতীয় সিনেমার অন্যতম একটা আইকনিক চরিত্র। যেকোনও ভাষাতেই 'পরিচারিকা'র চরিত্র থাকলেই 'মালতী'র চরিত্রটি দেখে নিতে বলেন পরিচালকরা। ওই চরিত্রটা এতটাই বিশ্বাসযোগ্য হয়েছিল যে ওটার পর থেকে গত ২০-২২ বছর আমি বহু পরিচারিকার চরিত্র করার প্রস্তাব পেয়েছি। কিন্তু আর কোনও পরিচারিকার চরিত্র আমি করতে চাইনি। কারণ আমি নিজেকে রিপিট করতে চাইনি।
তবে এখন যখন এই ছবির প্রস্তাব এল, দেখলাম এই চরিত্রটি নিয়েই গল্পটা। ‘হাসি’ই এখানে নায়িকা। ওর পৃথিবীটা নিয়েই সিনেমা। তাই রাজি হয়ে গেলাম। আমার এখন আর ছোট চরিত্রে অভিনয় করতে ভালো লাগে না বলে আমি বহু সিনেমা ছেড়ে দি। তবে অনেকদিন পর আমার কাছে দুটি ছবি এসেছে একটা 'অহনা', আরেকটা এই 'আপিস'। অহনা-তে আমি একজন লেখক, আর 'আপিস'-এ পরিচারিকা। দুটোই ভিন্ন চরিত্র, আমার ভালো লেগেছে, তাই রাজি না হয়ে পারিনি।
উচ্চবিত্ত হোক কিংবা নিম্নবিত্ত, মহিলাদের অবস্থান কিন্তু সবক্ষেতেই একই, এবিষয়ে আপনার ব্যক্তিগত মতামত কী?
সুদীপ্তা চক্রবর্তী: এটাই বাস্তব আসলে। বাণী বসু যখন কয়েক বছর আগে গল্প লিখেছিলেন, তখন মহিলাদের অবস্থা যা ছিল, এখনও তাই-ই আছে। একটা সিনেমা দেখে যে সবটা পাল্টে যাবে, এতটাও আমি আশা করি না। তবে ব্যতিক্রম থাকবেই। যেমন আমার বাড়িটা এবং আমার দিদির বাড়িটাও এক্ষেত্রে আলাদা। তবে এই ব্যক্তিক্রমটা শতাংশের হিসাবে এক্কেবারেই কম। সমাজে ধরেই নেওয়া হয় মায়ের একারই কাজ বাচ্চাকে সময় দেওয়া।
আপনার বাড়ি এক্ষেত্রে অনেকটাই ব্যতিক্রম, এবিষয়টা যদি একটু বলেন…
সুদীপ্তা চক্রবর্তী: আমার বাড়িতে এটা সত্যিই আলাদা। আমার বর সবটা দেখে নেয়। যদি আমার কাজের দিদি না আসে তো আমার স্বামীই সবটা সামলে নেন। যখন আমার মেয়ে ছোট ছিল, তখন তাই অতটাও অসুবিধা আমার হয়নি। তবে এটা সব বাড়ির ক্ষেত্রে তো সমান নয়।
বেশিরভাগ বাড়িতেও মহিলারা এভাবে, এতটা স্বামীকে পাশে পান না, এক্ষেত্রে সকলকে কী বলতে চাইবেন?
সুদীপ্তা চক্রবর্তী: আমি শুধু বলব, একটা মানুষকে মানুষ হিসাবেই দেখতে হবে। ছেলে বা মেয়ে হিসাবে নয়, তাহলেই দেখবেন অর্ধেক সমস্যা মিটে যাবে। একটা ছেলের এইগুলো করা উচিত, পুরুষ হয়ে জন্মেছে মানে তাকেই রোজগার করতে হবে, এটা যেমন একটা পুরুষের উপর অতিরিক্ত চাপ, আর মহিলা মানে তাকেই বাচ্চা দেখতে হবে, সংসারের সবটা সামাল দিতে হবে, এটাও একটা নারীর উপর অতিরিক্ত চাপ। বিপরীতটা হলে কী অসুবিধা?
ধরুন, কোনও পুরুষ ঠিক করেন, আমি বাড়ির সবটা সামলে নেব, আর আমার স্ত্রী বাইরে কাজ করবে, কেরিয়ার গড়বে, তাতে সমস্যা কোথায়? প্রত্যেককে মানুষ ভাবলেই আর এই সমস্যাটা থাকে না।
ছবিতে সন্দীপ্তার যিনি শাশুড়ি মা হয়েছেন, তিনি বাচ্চার 'ন্যানি' হতে রাজি হননি, এই বিষয়টা কীভাবে দেখেন?
সুদীপ্তা চক্রবর্তী: ছবিতে ওই যে শাশুড়ি মায়ের চরিত্রটা দেখানো হয়েছে উনি একজন স্বাধীনচেতা মহিলা। যিনি ছেলে-বউমার সঙ্গে থাকেন না। উনি বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন, সেখানকার কাজকর্ম দেখাশোনা করেন। যতবার উনি ছেলে-বউমাকে বলেন, তোরা আয়, মিস করছি, তখন পাল্টা বলা হয়, এই তো সেদিন গেলাম, কতবার যাব? এটা যদি মায়ের প্রতি ব্যবহার হয় তাহলে তো মুশকিল! এদিকে ন্য়ানি না থাকলেই বলা হচ্ছে তোমায় মিস করছি, তুমি চলে এসো, এটাও তো ঠিক নয়, তাই না? দুই পক্ষকেই সমান দায়িত্ব পালন করতে হবে। এক তরফা কিছুই হয়না।
আপনি একজন ব্যস্ত অভিনেত্রী, আবার ব্যক্তিগত জীবনে মা, সেক্ষেত্রে মেয়েকে কতটা সময় দিতে পারেন?
সুদীপ্তা চক্রবর্তী: সত্যিই কম সময় দিতে পারি। তাও আপ্রাণ চেষ্টা করি, সেটা মা বলে নয়, ওর অভিভাবক বলে।
এজন্য শাহিদার তরফে কোনও অভিমান বা অভিযোগ কি আসে? ও কি মিস করে?
সুদীপ্তা চক্রবর্তী: মিস তো করেই। একটা যেটা সমস্যা, আমার ক্লাসগুলোও শনি-রবিবার। আর ওর ছুটি ওই দুদিন। এই বিষয়টা ও গত ৪-৫ বছর ধরে দেখে আসছে। আবার এটাও ঠিক যে আমি বাড়িতেই উপরের ফ্লোরে ক্লাস করাই, ও কিন্তু এটা ও দেখছে যে মা কোথাও গপ্পোগুজব করে কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে পার্টি করার জন্য ওকে সময় দিচ্ছে না এমনটা নয়। ও নিজেও ক্লাসে মাঝে মধ্যে এসে বসে, দেখে আমি কতটা পরিশ্রম করি। তবে আবার কখনও বলে মাম্মা আমার সঙ্গে ব থাকো, আমি আজ সারাদিন তোমাকে চাই। তবে ও খুব যে কমপ্লেনিং বাচ্চা সেটা নয়। এটা আসলে বাবা-মায়েরও দায়িত্ব বাচ্চাকে বোঝানো।
আপনি দক্ষ অভিনেত্রী, তারপরেও এই চরিত্রটার জন্য আলাদা করে কোনও প্রস্তুতি কি নিতে হয়েছিল?
সুদীপ্তা চক্রবর্তী: চিত্রনাট্যটা খুব ভালো করে পড়েছি। আমি আর তথাগত বারবার বসেছি এটা নিয়ে। ওর যেহেতু এতবড় চরিত্র এই প্রথম, তাই আমরা চরিত্রগুলো, দৃশ্যগুলো নিয়ে আলোচনা করেছি। কীভাবে ওই শ্রেণির মানুষদের মতো করে কথা বলব, যাতে চরিত্রটা আরও বেশি বিশ্বাসযোগ্য হয়। আর এমনিতে আমি চারপাশে মানুষজনকে, জীবনকে খুব ভালো করে পর্যবেক্ষণ করি, এটা অবশ্য যেকোনও অভিনেতারই করা উচিত, করেনও সকলে। তাই আমি এজীবনে এত 'হাসি'কে দেখেছি যে খুব কঠিন কিছু মনে হয়নি। বাণী বসুর গল্পে এই চরিত্রটা খুব সুন্দর করে তুলে ধরা আছে। তাছাড়া পদ্মনাভ যে সংলাপ লিখেছেন, তাতে অনেকটাই হাসিকে বোঝা যাচ্ছে। আমার মনে হয় অভিনেতারা গল্পটা পড়লে, চিত্রনাট্য পড়ে একটু নিজের মতো করে বিষয়টা তৈরি করে নিয়ে বিষয়টা খুব কঠিন হয় না।
এবার আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সেটা হল 'আপিস' ছবিটা ঠিক মতো হল পাচ্ছে না, শোও পাচ্ছে না, এটা কেন? নন্দন-এর মতো হলেও জায়গা হল না ছবিটা,কেন?
সুদীপ্তা চক্রবর্তী: এটা তো নন্দন কর্তৃপক্ষই বলতে পারবেন। আমি শুধু অভিনয় করেছি। এটা হয় ডিস্ট্রিবিউটর বা সেই হল কর্তৃপক্ষই বলতে পারবেন। তবে নন্দনের মতো হল পেলে অবশ্যই ভালো হত। কারণ, অনেকেই এমন আছেন, যাঁদের পক্ষে অনেকটা টাকা খরচ করে মাল্টিপ্লেক্স গিয়ে ছবি দেখা সম্ভব নয়।
ছবিটা নিয়ে খুব বেশি প্রচারও তো হয়নি, এটা কেন?
সুদীপ্তা চক্রবর্তী: হ্যাঁ, এটা ঠিক কথাই। সত্যিই 'আপিস' নিয়ে প্রচার কমই করা হয়েছে। এটা কেন, তার উত্তরও আমার কাছে নেই। যতটা প্রয়োজন ছিল প্রচারের তা একেবারেই হয়নি। আর এত ছবি একসঙ্গে রিলিশ করছে, এদিকে হল তো সীমিত, দেবেই বা কীভাবে? আমার কাছে প্লেট আছে ১০টা, অতিথি এসে গিয়েছেন ১৫জন, এখানে সেই ব্যাপার আর কী! এখানে উপায় নেই আসলে।
এর সঙ্গে কি আরজি করের ঘটনা বা পরিচালক-ফেডারেশন দ্বন্দ্বের কোনও সম্পর্ক আছে?
সুদীপ্তা চক্রবর্তী: থাকতেও পারে, তবে এর তো কোনও প্রমাণ নেই, তাই অভিযোগ করি কীভাবে? যেমন আমি 'বিনোদিনী অপেরা'র জন্য কোনও সরকারি হল পাই না। আমাদের নাটকের দলের পরিচালক, অভিনেতাদেরও অনেকেই সেই আন্দোলনে রাস্তায় নেমেছিলেন, তাঁরা কেউই গত কয়েকমাসে সরকারি হল পাননি। কিন্তু এর তো আবার কোনও লিখিত প্রমাণ নেই। তাই আমি অভিযোগই বা কীভাবে করি!
অনেকেই বলেন 'বাংলা ছবির পাশে দাঁড়ান', কিন্তু এমন হলে তো সমস্যা…
সুদীপ্তা চক্রবর্তী: আমি এই কথাটা কখনওই কাউকে বলিনি, বলবও না। মানুষ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে হলে যাবে, তাঁর যেটা ভালো লাগবে, সেটাই দেখবেন। তবে দেখার সেই সুযোগটাও তো মানুষকে দিতে হবে, যে ছবিটা এসেছে। সেজন্য প্রচুর প্রমোশন করতে হবে, নয়ত অনেক শো থাকতে হবে যাতে লোকমুখে প্রচার হয়।
আসলে এত ছবি আসছে। সেখানে আমাদের এই ছবিটা খুব বড় প্রযোজনা সংস্থার নয়, স্টার ডিরেক্টর, অভিনেতারা এখানে নেই। তাই এখানে প্রচার কিংবা বেশি শো, কোনও একটা থাকা জরুরী। তবে আমার ধারণা, পরের সপ্তাহে আমরা বেশি শো পাব। আমি আশাবাদী…।