জলাভূমি জঙ্গল হোক বা ইঁট কাঠ পাথরের শহুরে বাড়ি। সর্বত্রই যে প্রাণীটির অবাধ বিচরণ, সেটি হল মশা। মশাকে মেরে বা ধূপের ধোঁয়া দিয়ে শায়েস্তা করা গেলেও কখনও কখনও এই কীটগুলি গুরুতর রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গির মতো প্রাণঘাতী রোগে প্রতি বছরই বহু মানুষ আক্রান্ত হন। চিকিৎসা পরিকাঠামো উন্নত হওয়ায় বর্তমানে মৃত্যুহার কমেছে। তা সত্ত্বেও মানুষের মধ্যে দরকার সচেতনতা বৃদ্ধি। সচেতনতার বাড়ানোর প্রয়াসেই প্রতি বছর আয়োজন করা হয় বিশ্ব মশা দিবস। বর্ষার সময় রাজ্য জুড়ে ডেঙ্গির প্রকোপ বাড়ে। ফর্টিস হাসপাতালের ইন্টারনাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জয়দীপ ঘোষ এই বিষয়েই তুলে ধরলেন রোগটির কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক।
কী কী উপসর্গ?
চিকিৎসকের কথায়, ‘এডিস মশার কামড়েই ডেঙ্গি, চিকুনগুনিয়া বা জিকা ছড়ায়। সাধারণত অন্যান্য মশার কামড়ের মতোই চুলকানি বা হালকা ফোলাসহ একটি ছোট লাল ফুসকুড়ি দেখা যায়। তবে, সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হল কামড়ের কয়েক দিনের মধ্যে জ্বর বা ফ্লু-এর মতো উপসর্গ।’
কখন কামড়ায় এডিস মশা?
ডাক্তার জানাচ্ছেন, ‘এডিস মশা প্রায়শই শরীরের অনাবৃত অংশে বিশেষত হাত, বাহু, পা এবং গোড়ালিতে কামড়ায়। কারণ শরীরের এই অংশগুলি দিনের বেলায় যখন মানুষ সক্রিয় থাকে। আর তখন সবচেয়ে সহজে মশা কামড়াতে পারে। ম্যালেরিয়ার মশা রাতে কামড়ায়, তাদের থেকে এডিস মশা ভিন্ন। এডিস দিনের বেলায় কামড়ানো মশা। সূর্যোদয়ের পর খুব সকালে এবং সূর্যাস্তের আগে শেষ বিকেলে এদের কামড়ানোর প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। এই সময়ে উচিত সতর্ক থাকা, গা ঢাকার মতো পোশাক পরা এবং মশা তাড়ানোর স্প্রে ব্যবহার করা।’
কীভাবে বাঁচবেন ডেঙ্গি সংক্রমণ থেকে?
ডেঙ্গি জ্বর মশাবাহিত ভাইরাল অসুখ যা এডিস ইজিপ্টাই মশা কোনও সংক্রামিত ব্যক্তিকে কামড়ালে এবং সেই ভাইরাস মানুষের শরীরে ছড়িয়ে দিলে হয়। এক্ষেত্রে নিজেকে রক্ষা করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হল মশার কামড় প্রতিরোধ করা। যার জন্য জরুরি আশেপাশের পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, মশা যাতে বংশবৃদ্ধি করতে না পারে সেজন্য কোথাও জল জমতে না দেওয়া এবং বাড়িতে ও বাইরে মশা তাড়ানোর স্প্রে ব্যবহার করা। সংক্রমণের সর্বোচ্চ মরসুম বা যখন ডেঙ্গি ছড়ায়, তখন মশার কামড় থেকে ত্বককে বাঁচাতে ফুল-হাতা শার্ট এবং প্যান্ট পরাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
ডেঙ্গির ফলে যে যে বিপদ
বর্তমানে ডেঙ্গির জন্য কোনও নির্দিষ্ট ভ্যাকসিন বা অ্যান্টিভাইরাল চিকিৎসা নেই। এই অসুস্থতা সাধারণত হঠাৎ করে প্রচণ্ড জ্বর দিয়ে শুরু হয়। প্রায়শই কাঁপুনি, প্রচণ্ড মাথাব্যথা, পেশী ও জয়েন্টে ব্যথা এবং কখনও কখনও ফুসকুড়ি এর সঙ্গে থাকে। চার থেকে পাঁচ দিন পর, রোগীর প্লেটলেট কাউন্ট কমে যেতে পারে। পেটে ব্যথা হতে পারে বা রক্তপাতের প্রবণতা দেখা দিতে পারে, যা জটিলতার লক্ষণ। দাঁতের মাড়ি, নাক, প্রস্রাব বা মল দিয়ে রক্তপাত হতে পারে এবং গুরুতর ক্ষেত্রে এটি জীবনঘাতী হতে পারে।
ডেঙ্গির চিকিৎসা কীভাবে হয়?
শরীরে জলের পরিমাণ স্বাভাবিক রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তা জল খেয়ে হোক বা গুরুতর ক্ষেত্রে স্যালাইন দিয়ে হোক। উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসার মধ্যে রয়েছে জ্বর নিয়ন্ত্রণ, অ্যান্টি-অ্যালার্জিক দিয়ে ফুসকুড়ি কমানো এবং প্লেটলেট কাউন্টের উপর নজর রাখা। যদি প্লেটলেট গুরুতরভাবে কম মাত্রায় নেমে যায়, তবে রক্ত সঞ্চালনের প্রয়োজন হতে পারে।
ডেঙ্গি মানেই ভয় নয়
সময় মতো চিকিৎসার হস্তক্ষেপ এবং সতর্ক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে, বেশিরভাগ রোগী ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে সুস্থ হয়ে ওঠেন। মূল বার্তাটি সহজ: প্রতিরোধের চেয়ে প্রতিকার ভালো। নিজেকে মশার কামড় থেকে রক্ষা করা এবং প্রথম লক্ষণ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত চিকিৎসকের সাহায্য নেওয়া জীবন বাঁচাতে পারে।
পাঠকদের প্রতি: প্রতিবেদনটি চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে তাঁর মতামতের ভিত্তিতে লেখা হয়েছে। এটি সমস্যাটি সম্পর্কে সাধারণ ধারণার উপর আলোকপাত করা মাত্র। ব্যক্তিবিশেষে প্রতিটি সমস্যার চিকিৎসা এবং নিরাময়ের পদ্ধতি পৃথক। তাই যে কোনও সমস্যায় শুধুমাত্র এই প্রতিবেদনের কথায় ভরসা না রেখে, ব্যক্তিগতভাবে চিকিৎসকের বা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।