এশিয়া কাপে নাটকের পর নাটক। আর তার নেপথ্যে রয়েছে পাকিস্তান। গত রবিবার এশিয়া কাপে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ ঘিরে হাত না মেলানো বিতর্কে কার্যত ভেসে গিয়েছে ক্রিকেটবিশ্ব। পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি) নিশানা করে ম্যাচ রেফারি অ্যান্ডি পাইক্রফটকে। তারা দাবি করেছিল, পাইক্রফটকে অবিলম্বে সরাতে হবে। না হলে তারা খেলবে না। এমন পরিস্থিতিতে যিনি একাহাতে সামনে দাঁড়িয়ে এই পাকিস্তানের ‘আবদার’ খারিজ করে দিয়েছেন, তিনি চেয়ারম্যান জয় শাহ নন, আইসিসির নবনিযুক্ত ভারতীয় সিইও সংযোগ গুপ্তা।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর দুবাই আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের টসের পর থেকেই শুরু হয় নাটক। ভারতীয় অধিনায়ক সূর্যকুমার যাদব করমর্দন করেননি পাকিস্তানের অধিনায়ক সলমন আঘার সঙ্গে। দলপত্র বিনিময়ও হয়নি। ভারতের ব্যাখ্যা ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট, গত ২২ এপ্রিল পহেলগাঁও জঙ্গি হানায় ২৬ জন সাধারণ মানুষের মৃত্যুর পর পাকিস্তানের সঙ্গে সৌজন্য-সৌহার্দ্য সম্ভব নয়। সেই অবস্থানেই আগাগোড়া অনড় থাকেন সূর্যকুমার।পিসিবি অবশ্য এই ঘটনার দায় চাপায় ম্যাচ রেফারি পাইক্রফটের ঘাড়ে। পাক বোর্ড অভিযোগ তোলে, তিনিই নাকি নাটের গুরু। পাক অধিনায়ককে হাত না মেলানোর উপদেশ দেন। এমনকী টিমশিট বিনিময়েরও বিরোধিতা করেছেন। এই আচরণকে ‘স্পিরিট অফ ক্রিকেটে’র বিরোধী বলে চিহ্নিত করে তাঁকে সরানোর দাবি তোলে পিসিবি।তিনবার পাইক্রফটকে সরানোর জন্য আইসিসি-র চাপ তৈরি করে পাকিস্তান। প্রস্তাব উঠে, বদলি হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হোক রিচি রিচার্ডসনকে। শুধু তাই নয়, গত ১৭ সেপ্টেম্বর আমিরশাহির বিরুদ্ধে ম্যাচের আগে পাক দল নির্ধারিত সময়ে হোটেল ছেড়ে বেরোয় না। ফাঁপা হুমকি দেয়, যদি রেফারি পালটানো না হয়, তারা মাঠে নামবে না।
সংবাদমাধ্যম ক্রিকবাজের এক প্রতিবেদন অনুসারে, এই সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে এগিয়ে আসেন আইসিসির সিইও সংযোগ গুপ্তা।চলতি বছর জুলাই মাসে আইসিসির সিইও হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি। পুরো আলোচনায় সামনের সারিতে ছিলেন সংযোগ। তাঁর নেতৃত্বেই আইসিসি নত হতে অস্বীকৃতি জানায়। অন্যদিকে, পিসিবির প্রতিনিধিত্ব করেন চেয়ারম্যান মহসিন নকভি এবং সিওও সলমন নাসির। পাকিস্তানের প্রতিটি ইমেলের পাল্টা জবাব গিয়েছে সংযোগ গুপ্তার দফতর থেকে। মোট ছয় দফায় ইমেল আদান-প্রদান হয়েছে। তিনটি পিসিবির তরফে, তিনটি আইসিসির পক্ষ থেকে। প্রতিবারই এক উত্তর, পাইক্রফটকে সরানো হবে না।এরপরও নাছোড়বান্দা পিসিবি। তখন আইসিসির ভেতরে আলোচনা হয়, অন্তত এক ম্যাচের জন্য হলেও পাইক্রফটকে সরানো যায় কিনা, যাতে পাকিস্তান কিছুটা ‘মুখরক্ষা’ করতে পারে। কিন্তু এখানেও শেষ কথা বলেন সংযোগ। স্পষ্ট জানিয়ে দেন, কোনওরকম আপস করা যাবে না। প্রমাণ ছাড়া এমন নজির তৈরি হলে ভবিষ্যতে যে কোনও দেশ একইভাবে চাপ সৃষ্টি করবে। এতে ম্যাচ অফিসিয়ালদের কর্তৃত্বই প্রশ্নের মুখে পড়বে।শেষমেশ নাটক মেটে। পাকিস্তানের মাঠে নামে।
সংযোগ গুপ্তা কে?
ভারতের ক্রীড়া-মিডিয়ার সঙ্গে সংযোগ গুপ্তার যোগ নিবিড় ও বহু পুরনো। আইসিসি-র দায়িত্ব গ্রহণের আগে ২০২৪ সালে ভায়াকম১৮ ও ডিজনি স্টারের মিশ্রণে তৈরি জিওস্টারের সিইও ছিলেন তিনি।সেখানেও কনটেন্ট কৌশল ও বাণিজ্যিক বৃদ্ধির সমন্বয়ে হয়ে ওঠেন প্রভাবশালী মুখ।২০১০ সালে স্টার ইন্ডিয়ায় যোগ দিয়ে অল্প সময়েই উঠে আসেন শীর্ষে। ২০২০ সালে ডিজনি স্টারের প্রধান ক্রীড়া সম্পাদক হন সংযোগ। তাঁর হাত ধরে চালু হয় বহুভাষিক সম্প্রচার, ডিজিটাল–ফার্স্ট কাভারেজ, মহিলাদের খেলাধুলায় বাড়তি নজর। তিনি আইপিএল, আইসিসি ইভেন্ট, আইএসএল বা প্রো কাবাডি-সব কিছুকেই ভারতীয় দর্শকের কাছে নতুনভাবে হাজির করেছিলেন।এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ২০২৫ সালের শুরুর দিকে আইসিসি বোর্ড তাঁকে সিইও হিসেবে বেছে নেয়। ২৫টি দেশের ২৫০০ জন প্রার্থীর মধ্য থেকে সংযোগ গুপ্ত সর্বসম্মতিক্রমে নির্বাচিত হন। তাঁর লক্ষ্য স্পষ্ট, বিশ্ব ক্রিকেটকে নতুন বাজারে পৌঁছে দেওয়া, ডিজিটাল উদ্ভাবনে নতুনত্ব আমদানি এবং ২০২৮ লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিকে ক্রিকেটের স্থানপ্রাপ্তি।
ক্রিকেট মহলের প্রশংসা
ইতিমধ্যে সংযোগ গুপ্তার পাকিস্তান-সংক্রান্ত কঠোর কিন্তু ন্যায়সঙ্গত ভূমিকার প্রশংসা করছে ক্রিকেট মহল। তাঁর দৃঢ় অবস্থান বুঝিয়ে দিচ্ছে, রাজনৈতিক চাপ বা হুমকিতে তিনি মাথানত করবেন না। বরং প্রক্রিয়া মেনে, নিরপেক্ষভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন। এশিয়া কাপের পাইক্রফট বিতর্কই হয়ে থাকল মেয়াদের প্রথম বড় চ্যালেঞ্জ। আর সেই চ্যালেঞ্জ জিতে সংযোগ কলার তুলতেই পারেন।