সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার ভোর পর্যন্ত প্রবল বৃষ্টিতে কার্যত জলের তলায় গোটা মহানগর। শহরের বিভিন্ন প্রান্তে বৃষ্টিপাতের অঙ্ক একেবারে আকাশছোঁয়া। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসছে একের পর এক মৃত্যুর খবর। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, কলকাতায় এই বৃষ্টি কী আসলে মেঘভাঙা বৃষ্টি? এই প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব দিয়েছে আলিপুর আবহাওয়া দফতর।
কলকাতায় মেঘভাঙা বৃষ্টি?
আলিপুর আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, এই ক্লাউড বার্স্ট নয়। নিম্ন চাপের প্রভাবেই অতিবৃষ্টি হয়েছে কলকাতায়। ভোর রাত তিনটে থেকে চারটে পর্যন্ত সর্বোচ্চ আটানব্বই(৯৮) মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। সাধারণত, কোনও একটি নির্দিষ্ট জায়গায় ১ ঘণ্টায় ১০০ মিলিমিটার বা তার বেশি বৃষ্টি হলে, সেটাকে ক্লাউড বার্স্ট বলা হয়ে থাকে। কিন্তু সামান্য বৃষ্টি কম হওয়ার কারণে এই বৃষ্টিকে মেঘভাঙা বৃষ্টি বলা হচ্ছে না। তবে বৃষ্টির জেরে এখনও জলমগ্ন রাজ্যের বহু এলাকা। শুধু কলকাতা নয়, দক্ষিণ ২৪ পরগনার সোনারপুরেও রেকর্ড বৃষ্টি হয়েছে। মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত সোনাপুর এলাকায় বৃষ্টিপাত হয়েছে প্রায় ২৪৭ মিলিমিটার। প্রবল বর্ষণে বিপর্যস্ত জনজীবন। এত বিপুল পরিমাণ বৃষ্টির জলে রাস্তাঘাট ও ঘরবাড়ি জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। জল নামানোর জন্য একাধিক জায়গায় পাম্প চালানো হলেও, জল নামতে আরও ৪৮ ঘণ্টা সময় লাগবে।
বিপর্যস্ত স্বাস্থ্য পরিষেবা
অন্যদিকে, অতি ভারী বৃষ্টির জেরে জলে ভাসছে কলকাতার উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম। বিপর্যস্ত ট্রেন, মেট্রো পরিষেবা। কয়েকটি সরকারি বাস চললেও, বেসরকারি বাসের দেখা নেই। দীর্ঘ ২০ বছরের এমন কলকাতার এমন জলমগ্ন অবস্থা দেখেনি তিলোত্তমা, এমনটাই দাবি বাসিন্দাদের। শুধুই যে রাস্তাঘাট, ট্রেনলাইন জলের তলায় তা নয়, কলকাতার প্রায় সব সরকারি হাসপাতালে এবং বেশ কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যেও ঢুকেছে জল।বর্তমানে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্রশাসনিক বিভাগ জলমগ্ন। সুপারের অফিসের ভিতরেও এক হাঁটু সমান জল। অ্যানাটমি বিভাগ, প্যাথলজি বিভাগ, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সামনে কোমর সমান জল। যার জেরে ব্লাড টেস্ট-সহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে, শিয়ালদহ এনআরএস হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগ, সার্জারি, চেস্ট বিভাগের সামনে হাঁটুর উপরে জল উঠে গিয়েছে। আউটডোর পরিষেবাও বিপর্যস্ত।
আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও স্ত্রী ও প্রসূতি রোগ বিভাগ, সার্জারি ডিপার্টমেন্ট, কার্ডিওলজি ডিপার্টমেন্ট, মেডিসিন বিভাগের সামনে হাঁটু জল। কোনও রকমে আউটডোর পরিষেবা চলছে। পার্ক সার্কাস ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল আউটডোর পরিষেবা সম্পূর্ণ স্তব্ধ। ইমারজেন্সি থেকে গাইনি ডিপার্টমেন্ট কোমর সমান জল। এসএসকেএম হাসপাতাল ও প্রসূতি যোগ বিভাগের সামনে হাঁটু সমান জল। হৃদরোগ বিভাগের আউটডোর ভবন, ইএনটি অর্থোপেডিক সংস্থা বিভাগের সামনে হাঁটু সমান জল। পার্ক সার্কাস ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক্স রে রুমে জল থৈথৈ। জরুরি বিভাগ থেকে গাইনি বিভাগে রোগীকে ভয়াবহ অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে নাজেহাল অবস্থা রোগী এবং পরিবারের সদস্যদের।
দিঘায় বিশেষ সতর্কতা
কলকাতা যখন কার্যত জলের তলায় চলে গিয়েছে, তখন দিঘায় জারি হয়েছে বিশেষ সতর্কতা। হাই টাইডের কারণে মঙ্গলবার উত্তাল সমুদ্র। সঙ্গে দোসর হয়েছে প্রবল বৃষ্টি। এই পরিস্থিতিতে সতর্ক করছে প্রশাসন। সমুদ্রের পার ধরে চলছে মাইকিং। এমনকী উপকূল এলাকার বাসিন্দাদের জরুরি জিনিস গুছিয়ে রাখারও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। পূর্ব মেদিনীপুর জেলা বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের তরফে জানানো হয়েছে, সম্ভাব্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবিলায় জেলা প্রশাসন প্রস্তুত রয়েছে। বঙ্গোপসাগরের উপর তৈরি হওয়া গভীর নিম্নচাপ ক্রমেই স্থলভাগের দিকে এগিয়ে আসছে। রাজ্যের উপকূল-সহ বেশ কিছু জেলায় ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে। এই নিয়ে সতর্ক করে মাইকে প্রচার চলছে দিঘায়। মৎস্যজীবীদের গভীর সমুদ্র থেকে ফিরে আসতে বলা হয়েছে।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলা বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের তরফে জানানো হয়েছে, মঙ্গলবার রামনগর-১ ব্লক প্রশাসনের তরফে দিঘা-সহ সৈকত লাগোয়া এলাকাগুলিতে সতর্ক করে প্রচার চালানো হয়েছে। মৎস্যজীবীদের গভীর সমুদ্র থেকে ফিরে আসতে বলা হয়েছে। উপকূল এলাকার বাসিন্দাদের জরুরি কাগজপত্র গুছিয়ে রাখতে বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে মোবাইল, ইমার্জেন্সি লাইট চার্জ দিয়ে রাখতে বলা হয়েছে। অন্যদিকে, এদিনও বহু পর্যটক দিঘার সমুদ্রে স্নান করতে নামেন। রামনগর-১ ব্লকের পদিমা-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান তথা দিঘা-শঙ্করপুর হোটেলিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুশান্তকুমার পাত্র জানান, জেলা প্রশাসনের তরফে চরম সতর্কতা জারি করা হয়েছে। ভরা জোয়ারের সময়ে পর্যটকদের সমুদ্রে নামতে নিষেধ করা হয়েছে।