থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যে সীমান্ত সংঘাতে এখনও পর্যন্ত ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই দফায় দফায় লড়াই দু’দেশের সেনার। দু’পক্ষের তরফেই চলেছে গোলাগুলি। কম্বোডিয়ার সেনা পরিকাঠামো গুঁড়িয়ে দিয়েছে থাইল্যান্ডের যুদ্ধবিমান। পাল্টা থাইল্যান্ডের সুরিন প্রদেশে রকেট হামলা চালায় কম্বোডিয়া।আর এই সংঘাতের কেন্দ্রে রয়েছে এক ঐতিহাসিক হিন্দু মন্দির, প্রাসাত তা মুয়েন থম। যুদ্ধবিমান, রকেট হামলা, কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা, সীমান্তে ল্যান্ডমাইন- সব কিছু মিলিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পরিস্থিতি এখন উত্তপ্ত।
মন্দির ঘিরে সংঘাত
দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দুই প্রতিবেশির সীমান্ত বিবাদ পুরনো।থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়ার সীমান্তবর্তী দাংরেক পর্বতমালার উপরে অবস্থিত প্রাচীন খেমার সাম্রাজ্যের মন্দির প্রাসাত তা মুয়েন থম প্রায় ৯০০ বছরের পুরনো। এটি এক সময়ের খেমার শাসক উদয়াদিত্যবর্মন বা জয়বর্মণ সপ্তম-এর সময়ে নির্মিত হয়। ভগবান শিবকে উৎসর্গ করে হিন্দু মন্দির হিসেবে গড়ে ওঠে। বর্তমানে এটি থাইল্যান্ডের সুরিন প্রদেশের মধ্যে থাকলেও কম্বোডিয়া দাবি করে, ঐতিহাসিকভাবে এটি তাদের ভূখণ্ডের অন্তর্গত।এই মন্দিরের দখল ঘিরেই বারবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে।এই মন্দিরটি আসলে প্রাসাত তা মুয়েন আর্কিওলজিকাল সাইট-এর একটি অংশ, যেখানে তিনটি প্রাচীন মন্দির রয়েছে পাশাপাশি যথাক্রমে প্রাসাত তা মুয়েন থম, প্রাসাত তা মুয়েন, এবং প্রাসাত তা মুয়েন তট।
প্রাসাত তা মুয়েন থম প্রধান এবং সবচেয়ে পুরনো মন্দির। এটি শিবের উপাসনার জন্য নির্মিত হিন্দু মন্দির। তিনটি পৃথক প্রাসাদের একটি কমপ্লেক্স, যার মধ্যে কেন্দ্রীয় মন্দিরটি সবচেয়ে বড়। মন্দিরটি বালি পাথর দিয়ে তৈরি এবং দক্ষিণমুখী। মূল মন্দিরের ভিতরে একটি প্রাকৃতিক শিলাস্তম্ভ থেকে গঠিত শিবলিঙ্গ রয়েছে। অন্যদিকে, প্রাসাত তা মুয়েন প্রায় ৩৪০ মিটার দূরে অবস্থিত এই মন্দিরটি মহাযান বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ধর্মশালার মতো। এটি ১৮টি তীর্থস্থান নির্মাণ প্রকল্পের অন্তর্গত যা রাজা জয়বর্মণ সপ্তম নির্মাণ করেছিলেন। প্রাসাত তা মুয়েন তট মন্দিরটি স্থানীয় জনগণের চিকিৎসাকেন্দ্র বা হাসপাতাল হিসাবে ব্যবহৃত হত। ১৩শ শতকে নির্মিত এই ধর্মস্থানে একটি তাম্রলিপিতে লেখা প্রাচীন খেমার ও সংস্কৃত শিলালিপি পাওয়া গেছে, যেখানে বৌদ্ধ চিকিৎসাশাস্ত্রের দেবতা ফ্রা ফাইসাচায় খুরু ওয়াইতুরায়ার উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে।
সংঘাতের সূত্রপাত
১৯০৪ সালে ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসকরা থাই-কম্বোডিয়া সীমান্ত নির্ধারণ করে। তবে ১৯০৭ সালের মানচিত্রে ‘প্রাহ ভিহিয়ার’ মন্দির কম্বোডিয়ার অংশ হিসেবে দেখানো হয়, যদিও ভূপ্রাকৃতিকভাবে সেটি থাইল্যান্ডে পড়ে। থাই সরকার তখন চুপ থাকলেও ১৯৩০-এর দশকে আপত্তি তোলে। পরে ১৯৫৯ সালে কম্বোডিয়া আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করে এবং ১৯৬২ সালে আদালত তাদের পক্ষে রায় দেয়।২০০৮ সালেও নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হয়, যখন কম্বোডিয়া এককভাবে এই মন্দিরকে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য হিসাবে ঘোষণা করতে চায়। এরপর বহুবার সংঘর্ষ হয়েছে, বিশেষ করে ২০১১ সালে এক সপ্তাহের সংঘর্ষে ১৫ জন নিহত হন।
সম্প্রতি থাই সেনা অভিযোগ করে, কম্বোডিয়া সীমান্ত এলাকায় নজরদারি ড্রোন পাঠিয়েছে। পরে একটি ল্যান্ডমাইনে আহত হন পাঁচ থাই সেনা। থাইল্যান্ড দাবি করে, কম্বোডিয়ার পাতা মাইনই বিস্ফোরণ ঘটায়। কম্বোডিয়া দাবি করে, ওগুলি পুরনো যুদ্ধকালীন সময়ের অবশিষ্ট মাইন।এরপরই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। থাইল্যান্ড কম্বোডিয়ার রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করে সীমান্তপথ বন্ধ করে দেয়। কম্বোডিয়াও তাদের দূতাবাস সরিয়ে নেয় এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক নিম্নস্তরে নামিয়ে আনে। এরপর বৃহস্পতিবার সংঘর্ষ চরমে পৌঁছায়। থাই প্রদেশ-এ রকেট হানায় ছয় জন নিরীহ মানুষ মারা যান। পাল্টা থাইল্যান্ড এফ-১৬ যুদ্ধবিমান দিয়ে কম্বোডিয়ার সীমান্তে বোমা বর্ষণ করে, যাতে আরও দু’জনের মৃত্যু হয় বলে দাবি কম্বোডিয়ার।এখনও পর্যন্ত এই সংঘাতে ১৬ জন প্রাণ হারিয়েছেন।বাসস্থান ছেড়েছেন দুই দেশের সীমান্ত এলাকার ১ লক্ষ ২০ হাজারের বেশি মানুষ।
উল্লেখ্য, প্রাসাত তা মুয়েন থম কেবল একটি মন্দির নয়, এটি ইতিহাস, ধর্মীয় গর্ব এবং ভূরাজনীতির ত্রিমুখী সংঘাতের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। হিন্দু দেবতা শিবের নামে নির্মিত হলেও, এই মন্দির এখন দু’টি আধুনিক রাষ্ট্রের রাজনৈতিক আধিপত্যের কেন্দ্র।