স্বচ্ছ ভাবমূর্তি, দুর্নীতি-বিরোধী, ‘আম আদমি’- যে অস্ত্রে এতদিন দিল্লিতে বাজিমাত করে এসেছে আপ, সেটাই এবার অরবিন্দ কেজরিওয়ালদের পতনের কারণ হয়ে দাঁড়াল। পরিস্থিতি এমনই হল যে একের পর এক হেভিওয়েট আপ নেতা হেরে গেলেন। জিততে ব্যর্থ হলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়াল, প্রাক্তন উপ-মুখ্যমন্ত্রী তথা শিক্ষামন্ত্রী মণীশ সিসোদিয়া, মন্ত্রী সৌরভ ভরদ্বাজ, দুর্গেশ পাঠকের মতো আপ নেতারা। ভরাডুবির মধ্যে কিছুটা মুখ বাঁচিয়েছেন বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী অতিশী এবং গোপাল রাই, মুকেশ আহলাওয়াত এবং ইমরান হুসেনের মতো মন্ত্রীরা। তবে অতিশীর জয়টা মোটেও সহজ ছিল না। দীর্ঘক্ষণ পিছিয়ে থেকে জিতেছেন।
কেজরিদের স্বচ্ছ ভাবমূর্তিতে কালির ছিটে
আর সেই বিষয়টা একেবারেই অপ্রত্যাশিত নয় বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল। ওই মহলের মতে, কেজরিদের যে এতদিন স্বচ্ছ ভাবমূর্তি ছিল, সেটা গত পাঁচ বছরে চূড়ান্তভাবে ধাক্কা খেয়েছে। আবগারি দুর্নীতি মামলায় জেলে গিয়েছেন আপের দুই জনপ্রিয়তম 'মুখ' সিসোদিয়া এবং কেজরিওয়াল। তাঁরা রাজনৈতিক চক্রান্তের শিকার হয়েছেন বলে যতই দাবি করুন না, জনমানসে দু'জনেরই স্বচ্ছ ভাবমূর্তিতে কিছুটা হলেও কালির ছিটে লেগে যায়।
সেই দাগটা যে তাঁরা কিছুতেই তুলতে পারেননি, তা দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের ফল থেকেই বোঝা গিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের ২০১৩ সাল থেকে যে নয়াদিল্লিতে জিতে এসেছেন কেজরিওয়াল, সেখানে ৪,০৮৯ ভোটে হেরে গিয়েছেন কেজরিওয়াল। প্রায় ৭০০ ভোটে হেরে গিয়েছেন কেজরিওয়ালের প্রাক্তন ডেপুটি সিসোদিয়া।
‘শিসমহল’ বিতর্কে ধাক্কা খায় ‘আম আদমি’ ভাবমূর্তি
আবার কেজরিওয়ালদের যে ‘আম আদমি’ ভাবমূর্তি ছিল, সেটা ধাক্কা খায় ‘শিসমহল’ বিতর্কে। যে শব্দবন্ধটা কটাক্ষ করে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন কেজরিওয়ালের বাসভবনের জন্য ব্যবহার করে এসেছে বিজেপি। একাধিক রিপোর্ট অনুযায়ী, কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল অফ ইন্ডিয়ার (ক্যাগ) তথ্যে উঠে এসেছে যে প্রাথমিকভাবে মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন সংস্কারের জন্য ৭.৯১ কোটি টাকা খরচ হবে বলে ধরা হয়েছিল। শেষপর্যন্ত কাজের যখন বরাত দেওয়া হয়েছিল, তখন সেই অঙ্কটা বেড়ে পৌঁছে গিয়েছিল ৮.৬২ কোটি টাকা। আর কাজ শেষ হওয়ার জন্য দেখা গিয়েছিল যে ৩৩.৬৬ কোটি টাকা খরচ হয়েছে।
সেই বিষয়টি নিয়ে নির্বাচনী প্রচারে ‘আম আদমি’ (সাধারণ মানুষ) কেজরিওয়ালকে আক্রমণ শানিয়েছিল বিজেপি। পালটা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে কটাক্ষ করে 'রাজমহল' শব্দবন্ধ ব্যবহার করতে শুরু করেছিল। কিন্তু বিজেপি যেভাবে লাগাতার প্রচার চালিয়ে গিয়েছিল, তা জনমানসের উপরে যে যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছে, সেটা আজ স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, ওই বিষয়টি মানুষের মনে আরও দাগ কেটেছিল, কারণ কেজরিওয়াল বরাবর দাবি করে এসেছিলেন যে তাঁদের রাজনীতি হবে স্বচ্ছ। ভিআইপি সংস্কৃতি মুছে ফেলা হবে।
'সততার ভাবমূর্তিতে ধাক্কা লাগায় মোদী সমর্থকরা বিজেপিকে ভোট দেন'
আর নিজেদের যেটা ‘ইউএসপি’ বা ‘স্ট্রং পয়েন্ট’ ছিল, সেটাই আপের অধঃপতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিষয়টি নিয়ে স্বরাজ ইন্ডিয়া পার্টির সহ-প্রতিষ্ঠা তথা ভোট বিশেষজ্ঞ যোগেন্দ্র যাদব বলেছেন, ‘অনেক মোদী সমর্থকই (বিধানসভা নির্বাচনে) কেজরিওয়ালের জন্য ভোট দিচ্ছিলেন। কিন্তু এবার তাঁরা সেটা করেননি। আর কারণগুলির মধ্যে আছে - আপের সততার ভাবমূর্তিতে ধাক্কা লাগা, আবগারি দুর্নীতি এবং শিসমহল বিতর্ক।’
শুধু তাই নয়, সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, ২০১৩ সাল থেকে দিল্লির মসনদে থাকায় আপের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হাওয়া ছিল। তারইমধ্যে নিত্য কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ তোলা, লেফটেন্যান্ট গভর্নরের বিরুদ্ধে কাজে বাধা দেওয়ার যে অভিযোগ তোলার বিষয়গুলিকে ভোটারদের অনেকেই অজুহাত হিসেবে বিবেচনা করেছেন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
'রোজকার লড়াইয়ে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন মানুষ'
যোগেন্দ্র বলেন, ‘যে সংঘাত চলছিল, সাধারণ কাজগুলোকে অবহেলা করা হচ্ছিল এবং লেফটেন্যান্ট গভর্নরের সঙ্গে সরকারের নিত্যদিনের লড়াইয়ের বিষয়টির কারণে মোদী সমর্থকরা মনে করেছেন যে এবার তাঁদের বিজেপিকে সমর্থন করা উচিত।’ আর তার জেরেই সার্বিকভাবে একের পর এক আপ নেতা, মন্ত্রী হেরে গিয়েছেন।