সিরিজ: রঘু ডাকাত
পরিচালক: ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়
অভিনয়ে: দেব, অনির্বাণ ভট্টাচার্য, সোহিনী সরকার।
রেটিং: ৪.০/৫
বঙ্গদেশে রঘু ডাকাতের মতো ‘বিখ্যাত’ ডাকাত বোধকরি আর দুটো নেই। বাংলার বহু ছেলে-মেয়দের শৈশব কেটেছে দাদু-ঠাকুমার কাছে রঘু ডাকাতের গল্প শুনে। ডাকাত হলেও আদতে সে বাংলার রবিনহুড। সে একদিকে অত্যাচারী বড়লোকদের যম, অন্যদিকে দুঃখী, নিপীড়িত দরিদ্রদের ত্রাতা, দাতা। তবে তাঁকে নিয়ে নানা লোককাহিনী প্রচলিত থাকলেও, লিখিত কোনও ইতিহাস নেই। আর তাই বোধ হয় দেশের ইতিহাসের সঙ্গে কল্পনার রঙ মিশিয়ে কিংবদন্তী এই চরিত্রকে আরও রঙিন করে তোলা যায়। যা পরিচালক ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর স্বাবলীল ছন্দেই স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছে, কিন্তু কোনও ক্ষেত্রেই তা অতিরঞ্জিত হয়ে যায়নি। বরং ঠাস বুননে হয়ে উঠেছে যথার্থ।
কেমন হল রঘু ডাকাত?
এই ছবিতে কাহিনীর শুরু গল্প শোনার আসর থেকেই। গল্পে প্রেক্ষাপটে গরীবের ঘাম মাখা নীলরক্তের কান্না। ইংরেজ আর জমিদারদের অত্যাচারে তখন দরিদ্র কৃষকদের প্রাণ অতিষ্ঠ। তাদের চাবুকের আঘাতে সোনার বাংলার সোনার ধান ফলানো চাষীদের দেহ ফালাফালা, কারুরবা আবার সামনে দাঁড়িয়ে সাক্ষাৎ মৃত্যু। আর সেই মৃত্যু আর অত্যাচারের অন্ধকারের মাঝেই উষাকালের লাল টকটকে সূর্যের আলোর মতো প্রতিবাদ হয়ে এসে দাঁড়ায় রঘু। নীলকর সাহেবের চাবুকের হিসেবে মিলিয়ে দেয় গুনে গুনে। শুধু এতেই থেমে থাকে না সে। অহীন্দ্র বর্মণের মতো জমিদারদের অতিরিক্ত খাজনা থেকে নীলকর সাহেবদের নীল বিক্রির অর্থ সবটাই রঘু তার দলবল আর ছায়াসঙ্গী 'গুঞ্জা' নিয়ে লুটতে থাকে রঘু সে। এক হাতে লুট, এক হাতে দান। এই নিয়েই ছিল রঘুর রাজত্ব। আর সেই রাজত্বের রাজমাতা ডাকাত মা ছিল রঘুর ধ্রুবতারা। তবে তাঁদের এই সুখ-দুখে ঘরে হঠাৎ করে এসে পড়ে সৌদামিনী। প্রেম আর প্রেমমাখা ঈর্ষার এক টানাপোড়েন তৈরি হয় গুঞ্জা-রঘু-সৌদামিনীর মধ্যে। আর তা মাঝেই অহীন্দ্র বর্মণ ও দুর্লভ রায়ের চক্রান্তে গল্প নেয় নতুন মোড়, ডাকাত মাকে হারায় রঘু, ছাড়খার হয়ে যায় তার রাজত্ব। কিন্তু পর কি আর রঘু ঘুড়ে দাঁড়াতে পারবে? নিতে পারবে ডাকাত মায়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ? বাংলার মানুষের চোখের জলের হিসাব কি সে নিতে পারবে? তারই উত্তর মিলবে 'রঘু ডাকাত'-এ।
কার অভিনয় কেমন লাগল?
পর্দার রঘু ডাকাত দেব। ট্রেলার লঞ্চের সময় তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছিল এই ছবির জন্য নাকি তিনি ১০ মাস দাড়ি কাটেনি। তবে শুধু এটুকুই নয়। শারীরিক ও মানসিক দিক থেকেও নায়ক নিজেকে দারুণ ভাবে গড়ে পিটে তৈরি করেছেন। তাঁর অভিনয় কোনও পর্যায় গিয়েই মনে হবে না অতিরঞ্জিত। 'ধূমকেতু'তে নায়কের অভিনয় দারুণ ভাবে প্রশংসা পেয়েছিল। তবে সেখানে অতিরিক্ত অভিনয়ের জায়গাও ছিল না, কিন্তু এই চরিত্রটির ক্ষেত্রে অনেক জায়গায় মাত্রা ছাড়াতে পারত। কিন্তু সেই জায়গায়গুলোতেও নিজেকে সংযত রেখে যেখানে যতটা দরকার ঠিক ততটুকুই দিয়েছেন দেব। তাঁর পরিমিত অভিনয় দেখলে অবাক হতেই হয়। তবে এতে তাঁর হিরোসুলভ ভাব কোথাও এতটুকু ক্ষুণ্ণ হয়নি। সব মিলিয়ে বাংলার 'রঘু রাজা' তিনি। তাঁকে ছাড়া অন্যকাউকে এই চরিত্রে কল্পনাই করা যাবে। তবে কেবল দেব একা অনবদ্য নন।
সঙ্গে নজর কেড়েছেন 'গুঞ্জা' সোহিনী। এই ছবিতে তাঁর অভিনয় আলাদা ভাবে প্রশংসার দাবি রাখে। সোহিনী অসাধারণ অভিনয়, শরীরী ভঙ্গি, একদিকে চরিত্রে অদ্ভুত সারল্য, অন্যদিকে বীরত্বের পরাকাষ্ঠা সব মিলিয়ে তিনি সেরা। তবে দেব ও সোহিনী দু'জনেই দারুণ পারফর্মেন্স করলেও কেউ কখনও কাউকে ছাপিয়ে যেতে চেষ্টা করেননি। বরং একে অপরকে পরিপূর্ণতা দিয়েছেন বিশেষ বিশেষ দৃশ্যে। সঙ্গে আর একজনের কথা না বললেই নয় তিনি হলেন বিশ্বরূপ বিশ্বাস। তাঁর অভিনীত চরিত্রের বিশ্বাসযোগ্যতা ছবিকে অন্য মাত্রা দেয়। পাশাপাশি ছবির আর এক নায়িকা 'সৌদামিনী' অর্থাৎ ইধিকা পাল এই ছবিতে বেশ সাবলীল। লাস্য হোক বা অভিনয় দুই ক্ষেত্রেই তিনি নজরকাড়া। সঙ্গে উপরি পাওয়া বহু দিন পর পর্দায় রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ের দাপট। তিনি যতটুকু ছিলেন একেবারে ঘিরে রেখেছিলেন।
তবে আলোর পাশে অন্ধকারের মতো অহীন্দ্র বর্মণের চরিত্রে অনির্বাণ ভট্টাচার্য একেবারে মানানসই। প্রতিটি দৃশ্যে তিনি ক্রূরতা যে ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তা আলাদা করে বলতেই হয়। কেবল চোখ আর শরীরী ভঙ্গি দিয়েও হিংস্রতাকে কীভাবে ফুটিয়ে তুলতে হয় তা বেশ কিছু দৃশ্যে অনির্বাণ বুঝিয়ে দিয়েছেন। তাছাড়াও ওম সাহানিকে একেবারে অন্য রূপে দেখতে পাবেন দর্শকরা।
ওভারঅল কেমন লাগল?
প্রেম, প্রতিশোধ, বন্ধুত্ব, শত্রুতা, বাংলার ইতিহাস, নীল বিদ্রোহের আগুন সব মিলিয়ে এই ছবির গল্প বেশ বিনোদনমূলক। পুরো ছবি জুড়েই ঘটনার ঘটনা আর একের পর পর এক নতুন মোড় ছবির শুরু থেকে শেষে টানটান উত্তেজনা ধরে রাখে। তাই ছবির গল্প হোক বা কলাকুশলীদের অভিনয় সবটা নিয়েই পরিচালক ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশংসার দাবি রাখেন। ছবির অ্যাকশন সিক্যুয়েন্সও অনবদ্য। তবে ওম সাহানি অভিনীত 'দুর্লভ রায়' চরিত্রটি আর একটু সময় দিয়ে গড়ার প্রয়োজন ছিল। পাশাপাশি মূল চরিত্রদের পোশাকে দক্ষিণ প্রভাব এড়িয়ে আরও খানিকটা বাংলার মাটির কাছাকাছি করা গেলে তা আরও মনগ্রাহী হত। তবে এই সব কিছুর পরও ছবির উপস্থাপনা, দেব-সোহিনীদের অভিনয় ও আড়াই ঘন্টা জুড়ে বাংলার ইতিহাস তথা লোককথার এক অন্য অধ্যায়ের সাক্ষী হতে পুজোয় ঠাকুর দেখার মাঝে হলে গিয়ে একবার দেখে নিতেই পারেন রঘু ডাকাত। কারণ এই ছবির আসল মজা হল ভর্তি দর্শকদের মাঝে বসে বড় পর্দায় দেখে অনুভব করার মতো। সঙ্গে উপরি পাওনা হিসেবে মিলবে দেবের আসন্ন ছবি 'প্রজাপতি ২'-এর টিজার। পুজোয় এটাই বোধ হয় মেগা স্টারের পক্ষ থেকে তাঁর অনুরাগীদের উপহার।