‘চেনা ছক…এসব আমরা উপন্যাসে লিখি।’ বোন রিমি প্রতারিত হয়েছে জানতে পারার পর লেখিকা অহনা বলেছিল এই কথাই। অহনার এই একটি সংলাপ রিভিউটির গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত খেয়াল রাখলে ছবির মূল ভাব হয়তো ধরা যাবে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের এক চেনা ছকের উপরে এই সিনেমার গড়ে ওঠা। পিতৃতন্ত্র বা পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা সেই ছক। বহু পরিবারে মেয়েদের পাশাপাশি পুরুষরাও এই ছকের শিকার। মেয়েরা যে শুধু খাচায় বন্দি তা নয়, বন্দি ছেলেরাও। লিঙ্গনির্বিশেষে সবাইকে হাইজ্যাক করে রেখেছে এই ‘তন্ত্র’।
ছবির মূল চরিত্র অহনা একজন প্রতিষ্ঠিত লেখিকা। নাম, যশ, সবই তাঁর রয়েছে, নেই ব্যক্তিগত জীবনের সুখ। নীল তাঁর প্রতি যে প্রেম নিয়ে ঘর বেঁধে ছিল, সেই প্রেম যেন ম্লান হয়ে গিয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রেমের স্থান দখল করেছে ‘মেল ইগো’। তাঁর অহনার মন, শরীর পছন্দ হয় না। অহনার শ্বশুর পরিস্থিতিটা বোঝেন, পুত্রবধূকে সমর্থন করেন। কিন্তু স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক নয় বলে সবটাই মৃতপ্রায় অহনার কাছে। এই সমস্যার কফিনে শেষ পেরেক যেন সন্তানহীনতা। নীলের কিছু শারীরিক সমস্যার কারণে সন্তানধারণে জটিলতা দেখা দেয়। কিন্তু ভালোবাসার সংজ্ঞায় সন্তানহীনতা বারবার প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দাঁড়ায়। গল্পের মাঝামাঝি দেখা যায়, নীল নিজের প্রাধান্য বজায় রাখতে বন্ধুদের বলেন অহনার সমস্যা রয়েছে। এদিকে অহনা মা হতে চান আর তার জন্য প্রস্তুতিও নিচ্ছেন নানাভাবে। যদিও ভিতরে ভিতরে তাতে সায় নেই নীলের। ক্রমবর্ধমান এই সমস্যা অহনাকে শেষমেশ কোন দিকে নিয়ে যায়, তা জানতে সিনেমাটি একবার দেখে নেওয়াই ভালো।
ছবিতে সকলেরই অভিনয় বেশ ভালো। নবাগত হিসেবে নজর কাড়বে প্রিয়বত সেন সরকার। সৌম্য সেনগুপ্তের পরিমিত অভিনয় ও জয় সেনগুপ্তের প্রতিক্রিয়া, সংলাপ, অভিনয়ের কথা আলাদা করে বলতে হয়। প্রধান চরিত্রে সুদীপা চক্রবর্তীর অভিনয়ও নজর কাড়বে অনেকের।
ছবির কাহিনিতে আসা যাক। প্রমিতা ভৌমিকের ছবি অনেকগুলি প্রশ্নের মুখে আমাদের দাঁড় করায়। পিতৃতন্ত্রের মূল সমস্যা নিয়ে নানা প্রশ্ন ছবির গল্পের স্রোতে স্বাভাবিকভাবে উঠে এসেছে। কিন্তু কিছু প্রশ্ন উহ্যও রাখে। যেগুলি হয়তো কাহিনির সরলরৈখিক গতিকে অন্য রূপ দিতে পারত।
পিতৃ বা মাতৃ, এমন নাম বা চিহ্ন না দিয়ে এই বিশেষ তন্ত্রকে কি দমনের তন্ত্র বলা যায়? লিঙ্গনির্বিশেষে অন্যকে দমিয়ে রাখার, ছোট করার, নিচুতে রাখার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করার প্রবণতা— বলা যায়? যে ব্যক্তি সুপিরিয়র (অর্থ উপার্জন করেন বলে বা অন্য সামাজিক কারণে) পজিশনে থাকেন, এ কি তাঁরই সমস্যা নয়? প্রমিতা ভৌমিক আমাদের বোধহয় সেই বিষয়টি নিয়ে ভাবাতে পারতেন। ঠিক যেমন ভাবিয়েছেন, অভিব্যক্তি আবহসঙ্গীতের বিকল্প হয়ে উঠতে পারে কি না, তা নিয়ে। কাহিনিতে অন্য মাত্রা জুড়তে পারত অহনার শ্বশুর, যে কি না একদা তাঁর অধ্যাপক ছিল। কাহিনিতে অন্যতর স্রোত আনতে পারত অহনার বন্ধু আদিত্য। এমনকি কাহিনিতে বাঁকবদল ঘটাতে পারত শিশুকন্যার স্বপ্নও। পুরস্কারপ্রাপ্ত ও দক্ষ লেখিকা অহনাই কিন্তু মনে করিয়ে দিয়েছিলেন এই রিভিউয়ের প্রথম লাইনটা।