সচিন তেন্ডুলকর। মানুষ তাঁকে ক্রিকেটের ভগবান বলে। একমাত্র খেলোয়াড় যাঁর মধ্যে মহান ব্যাটসম্যান স্যার ডন ব্র্যাডম্যান নিজের প্রতিচ্ছবি দেখেছিলেন। এমন একজন খেলোয়াড় যিনি ক্রিকেটের রেকর্ড বইকে তছনছ করে দিয়েছেন। সব থেকে বেশি রান। সব থেকে বেশি সেঞ্চুরি এবং আরও কত রেকর্ড! অতুলনীয় শৃঙ্খলা এবং নম্রতা তাঁর মহত্ত্বকে আরও বাড়িয়ে তোলে। বৃহস্পতিবার অর্থাৎ ২৪ এপ্রিল সচিন তেন্ডুলকর পূর্ণ করছেন ৫২ বছর। অনেকেই হয়তো জানেন না যে তাঁর গুরু রমাকান্ত আচরেকর তাঁর ব্যাটিংয়ের সময় মিডল স্টাম্পের উপরে একটি কয়েন রাখতেন কেন?
সচিন তেন্ডুলকর... যাকে বর্ণনা করার জন্য শব্দও কম পড়ে যায়
সচিনের কথা বলতে গেলে তাঁকে বর্ণনা করার জন্য যেন অভিধানের শব্দও কম মনে হয়। সত্যিই তো, এমনি এমনি কেউ সচিন তেন্ডুলকর হয়ে ওঠেন না। তার জন্য চ্যালেঞ্জগুলোকে সুযোগ হিসেবে নিতে হয়। একাগ্রতা, পরিশ্রম, দৃঢ়তা, জেদ, উন্মাদনা, উদ্দীপনা, প্রেরণা, শৃঙ্খলা, নম্রতা, সাফল্যের কখনও না মেটা খিদে... এই সমস্ত বিশেষণ, সমস্ত গুণকে যদি সংজ্ঞায়িত করতে হয়, তাহলে শুধু সচিনের দিকে তাকান। এই শব্দগুলো, এই বৈশিষ্ট্যগুলোও যেন তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ যে. তেন্ডুলকরের ব্যক্তিত্ব বিশ্বকে দেখিয়েছে এই শব্দগুলোর আসল অর্থ কী। সচিন তেন্ডুলকরকে তাঁর গুরু রমাকান্ত আচারেকর বিশ্ব মাতানোর জন্য প্রস্তুত করেছিলেন এবং কী দারুণভাবেই না তৈরি করেছিলেন!
এমনিতে কেউ সচিন তেন্ডুলকর হয়ে ওঠেন না
সচিন তেন্ডুলকর ১০-১১ বছর বয়সে প্র্যাকটিসের জন্য বান্দ্রা ইস্ট থেকে ৩১৫ নম্বর বাসে করে শিবাজী পার্কে যেতেন। তিনি ১১ বছর বয়সে প্রথম রমাকান্ত আচকরের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। কোচ তাঁকে এক মাঠ থেকে অন্য মাঠে নিয়ে যেতেন।
ব্রিটিশ সংবাদপত্র দ্য টেলিগ্রাফ তাদের নিউজ ওয়েবসাইটে সচিন তেন্ডুলকরের সঙ্গে কথোপকথনের উপর ভিত্তি করে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে প্রথম দিকের দিনগুলোতে মাস্টার ব্লাস্টারের রুটিন সম্পর্কে বলা হয়েছে। গ্রীষ্মকালে তিনি সকাল সাড়ে ৭টা থেকে ২ ঘণ্টা নেট প্র্যাকটিস করে ব্যাটিংয়ে ঘাম ঝরাতেন। তারপর তিনি সরাসরি শিবাজি পার্কে যেতেন। গরমের মরশুমে ৬০ দিনে তিনি প্রায় ৫৫টি ম্যাচ খেলতেন।
আরও পড়ুন:- জলে গেল মেহেদির ‘১০ উইকেট’, জিম্বাবোয়ের কাছে হেরে পচা শামুকে পা কাটল বাংলাদেশের

এই ম্যাচগুলো সাধারণত বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত চলত। তারপর ৫টা বাজতে না বাজতে তেন্ডুলকর আবারও নেটে পৌঁছে যেতেন এবং পরের ২ ঘণ্টা আবার ঘাম ঝরাতেন। এই সময় তিনি ৫টা ছোট ছোট বিরতি নিতেন।
মিডল স্টাম্পে কয়েন রাখার সেই কাহিনী
কোচ রমাকান্ত আচরেকর তাঁর প্রিয় শিষ্যের জন্য প্র্যাকটিসের শেষ ১৫ মিনিটের সেশনে এমন কিছু করতেন, যা সচিনকে আরও বেশি করে নিখুঁত করে তুলেছিল। একে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় রিওয়ার্ড অ্যান্ড মোটিভেশন সেশন বলা যেতে পারে।
গুরু আচরেকর মিডল স্টাম্পে এক টাকার কয়েন রেখে দিতেন। সচিন যদি আউট না হয়ে পুরো সেশন পার করতে পারতেন, তাহলে সেই কয়েন তাঁর। এটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল, কারণ ১১ জন নয়, ২৫-৫০ জন এবং কখনও কখনও ৭০ জন পর্যন্ত ফিল্ডার থাকত। খেলার সব বড় পুরস্কার এবং দেশের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ভারতরত্নে সম্মানিত সচিন তেন্ডুলকরের জন্য সেই এক টাকার মুদ্রা পাওয়া সবচেয়ে বড় পুরস্কারের মতো ছিল।

ক্রিকেটের আকাশে সূর্যের উদয়
আচরেকররূপী গুরু দ্রোণের এই 'অর্জুন' সচিন তেন্ডুলকর যখন ১৪ বছর বয়সে ব্যাট হাতে এমন বিস্ফোরণ ঘটান, যা ক্রিকেটের আকাশের সূর্যের উদয় হওয়ার ঘোষণা ছিল। ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের এক দিন। শিবাজী ময়দান থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আজাদ ময়দান। অ্যানুয়াল ইন্টার-স্কুল টুর্নামেন্ট হ্যারিস শিল্ডের সেমিফাইনাল ম্যাচ। শারদাশ্রম বিদ্যামন্দির এবং সেন্ট জেভিয়ার্স হাই স্কুলের মধ্যেকার লড়াই।
বিদ্যামন্দিরের ৮৪ রানে দ্বিতীয় উইকেট পড়লে সচিন তেন্ডুলকর ব্যাট করতে নামেন। অন্য প্রান্তে ছিলেন তাঁর থেকে প্রায় ১৫ মাসের বড় এক ব্যাটার বিনোদ কাম্বলি। এই দুই ব্যাটার দ্বিতীয় দিনের লাঞ্চ পর্যন্ত ব্যাট করেন। দল ২ উইকেটে ৭৪৮ রানে ইনিংস ডিক্লেয়ার করে। কাম্বলি ৩৪৯ রানে অপরাজিত থাকেন এবং সচিন তেন্ডুলকর ৩২৬ রানে অপরাজিত ছিলেন। দু'জনের মধ্যে ৬৬৪ রানের রেকর্ড তথা অপরাজিত জুটি হয়। তারপরের সময়টা বিশ্ব ক্রিকেটের ইতিহাসে চিরকালীন জায়গা করে নিয়েছে। ক্রিকেটের এই সূর্য আন্তর্জাতিক মঞ্চে এমনভাবে চমকায় যে মানুষ তাঁকে 'ক্রিকেটের ভগবান'-এর মর্যাদা দিতেও কুণ্ঠা বোধ করেনি।