রাম-লক্ষণকে গোপনে হত্যার পরিকল্পনা করেছেন মহিরাবণ। মহিরাবণের উপাস্যা স্বয়ং মহাকালী। অবধূতা রামায়ণ অনুসারে, মহিরাবণ একদিন ফন্দি আঁটলেন রাম-লক্ষণকে পাতালে নিয়ে আসার। সেখানেই তাঁর আরাধ্যা দেবী। মহাকালীর সামনে তাঁদের বলি দেবেন মহিরাবণ। যথাসময়ে মহিরাবণ রাম-লক্ষণকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এলেন পাতালে। কিন্তু পাতালে পৌঁছনো মাত্রই রাবণের ফন্দি টের পেয়ে গেল লক্ষণ। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে বধ করলেন লক্ষণ। মহিরাবণ বধের পর ফেরার পালা। কিন্তু এই সময় হঠাৎ খেয়াল হল দেবীর কথা। দেবীকে তো এভাবে জলের নিচে রাখা যায় না! তখন হনুমানের সহায়তায় দেবীকে নিয়ে শুরু হল পাতাল থেকে ফিরে আসার যাত্রা। তিনদিন লেগে গিয়েছিল মর্ত্যে পৌঁছাতে। পাতালের নিকষ কালো ভেদ করে দেবী মর্ত্যের যে স্থানে প্রথম পা রাখলেন, তার নাম ক্ষীরগ্রাম।
আরও পড়ুন - বাংলার এখানেই মন পড়েছিল সতীর? দেশবিদেশের পর্যটকদের কাছে আজও অমোঘ আকর্ষণ এই শক্তিপীঠ
যোগাদ্যা মায়ের পুজোয় নরবলি
দেবী এখানে মন্দিরে অধিষ্ঠিতা নন। তিনি সারা বছর থাকেন জলের নিচে। বিশেষ বিশেষ তিথিতে তাঁকে জলের উপর এনে পুজো করার রীতি। যেমন বৈশাখ সংক্রান্তি তেমনই এক তিথি। ধুমধামের সঙ্গে এই তিথিতে যোগাদ্যা মায়ের পুজো হচ্ছে। কথিত আছে, আগে যোগাদ্যা মায়ের পুজোয় নরবলি হতো। এখন ছাগ ও মোষ বলি দেওয়া হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু নিয়মকানুন মানা হয় না আর। কিন্তু একই ভক্তিনিষ্ঠা সহকারে পুজিত হন মা।
৫১ সতীপীঠের অষ্টাদশ পীঠ
রাম-লক্ষণ চলে গেলেও দেবী যাননি ক্ষীরগ্রাম ছেড়ে। এই অঞ্চলের অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষের কাছে তিনি পুজো পেতে থাকলেন। মা যোগাদ্যা রূপে শুরু হয় মহামায়ার পুজো। অবধূতা রামায়ণ একদিকে যেমন এই কাহিনি বলে, তেমনই অন্যদিকে রয়েছে সতীপীঠের কাহিনি। দুই কাহিনি সমান্তরালে মায়ের মহিমা বহন করে চলেছে যুগ থেকে যুগান্তরে। কুব্জিকাতন্ত্রম ও বৃহন্নীলতন্ত্রে উল্লেখ রয়েছে, ক্ষীরগ্রামের। পীঠ নির্ণয় তন্ত্রে ৫১ সতীপীঠের অষ্টাদশ পীঠ হিসেবে উল্লেখ রয়েছে পূর্ব বর্ধমানের এই গ্রামের। শাস্ত্রমতে, সতীর ডান পায়ের বুড়ো আঙুলের অংশ এখানে পড়েছিল।
আরও পড়ুন - পুজো হয় ৫১ কুমারীর! তীব্র গরমেও শুকোয় না কুণ্ডের জল? এই সতীপীঠের কাহিনী জানেন?
সারা বছর জলে নিমজ্জিত থাকেন দেবী
স্থানীয় ইতিহাস বলছে, অষ্টাদশ শতকের তৃতীয় দশকে রাজা কীর্তিচাঁদ রায় প্রায় ৮ বিঘা জমির উপর মন্দির তৈরি করেন। মন্দিরটি তিনটি স্তরে বিন্যস্ত। মূল মন্দিরে কোনও মূর্তি থাকে না। সারাবছরই দেবী জলেই থাকেন। বৈশাখী সংক্রান্তির দিনে জল থেকে মা যোগাদ্যাকে তোলা হয়। মহাপুজোর শেষে ভোর রাতে ফের দেবীকে জলে নিমজ্জিত করা হয়। তিনদিন পর আবার জল থেকে তুলে দেবীকে মন্দিরে এনে অভিষেক করা হয়। এভাবে বছরে কয়েকটা নির্দিষ্ট দিনে দেবীকে জল থেকে তুলে পুজোর রীতি।
অন্নভোগ ও মেলা
পূর্ব-বর্ধমানের মঙ্গলকোটের এই গ্রামে প্রতি বছর এই পুজোকে ঘিরে ভিড় জমে লাখ লাখ মানুষের। বড় করে মেলার আয়োজন হয়। কৈচর রায়স মিলের পক্ষ থেকে প্রায় ১০ হাজার মানুষের জন্যে দুপুরে অন্ন ভোগ খাওয়ানো ব্যবস্থা ছিল এই বছর।