- পলা বন্দ্যোপাধ্যায়
ঐতিহাসিক, লেখিকা
বাবা বলতেন, একজন খেলোয়াড়ের সাফল্যের পিছনে ৯৯ শতাংশ কাজ করে পারস্পিরেশন, আর ১ শতাংশ ইনস্পিরেশন। মানে, প্রায় পুরোটাই খাটনি, ঘাম ঝরানো। আর সামান্য একটু ভাগ্য।
জন্ম থেকেই বাড়িতে সুপারস্টার একজন খেলোয়াড়কে দেখেছি। নিজের সময়ে বাবা ছিলেন দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলোয়াড়দের একজন। এমনটা বললে কেউ নিশ্চয়ই আপত্তি করবেন না। আমায় যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, কী কী গুণ থাকলে একজন খেলোয়াড় জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন, তার বিশ্লেষণ নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই করতে পারব।
বিরাট কোহলি টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়েছেন। নিঃসন্দেহে তিনি বর্তমান যুগের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলোয়াড়দের একজন। বাবাকে যখন জিজ্ঞাসা করতাম, তাঁর এই জনপ্রিয়তার পিছনে রহস্যটা কী, তিনি একটাই উত্তর দিতেন– ব্যতিক্রমী প্রচেষ্টা। বাবার বক্তব্য ছিল, প্রতিভা কমবেশি সকলের মধ্যেই থাকে। তা না থাকলে তাঁরা এত বড় দেশের বাছাই করা খেলোয়াড়দের মধ্যে থাকতে পারতেন না। তাহলে কেন কেউ কেউ বাকিদের থেকে কিছুটা এগিয়ে যান? কেন কেউ কেউ এক নম্বর হন? বাবার কথায়, যদি কাউকে এক নম্বর হতে হয়, তাঁকে নিজেকে এক নম্বর বলে ভাবতে হবে। আর সেটা পেরেছেন বলেই বিরাট কোহলি এক নম্বর হয়েছেন। খেলোয়াড় হিসাবেও, আইকন হিসাবেও।
বাবা সবসময় বলতেন, ‘তুমি নিজেকে যত নম্বর দেবে, পৃথিবী তোমায় তার ১০ শতাংশ দেবে। তাই তুমি যদি নিজেকে ১০০ শতাংশ মনে না করো, তাহলে তুমি দশও হবে না। কাজেই নিজেকে যদি সেরা বলে ভাবো ও সেরা হওয়ার ও সেরা হয়ে টিকে থাকার জন্য প্রচেষ্টা করো, তবেই তোমার স্বপ্নের কাছে পৌঁছে যাবে একদিন।’
এর বাইরে আরেকটা বিষয় আছে। অন্যদের চোখে সেটা চট করে ধরা পড়ে না। তা হল আত্মত্যাগ। এত জনপ্রিয় যাঁরা হন, এত সফল যাঁরা হন, তাঁদের সাফল্যের পিছনে থাকে বহু ত্যাগ। ১৯৫২ সালে এশিয়ান গেমসে যাওয়ার আগে বাবা, চুনীকাকা (চুনী গোস্বামী)-রা বিয়ে পর্যন্ত করেননি। এই ত্যাগ দরকার। বিরাট কোহলি ভাবলেই আমরা অনুষ্কা শর্মা ভাবি। কিন্তু অনুষ্কা শর্মা জানেন, কত কম সময় তিনি পান বিরাটের থেকে। বিরাটের অর্ধেকের বেশি সময় চলে যায় তাঁর খেলায়। বাবা বিরাট, স্বামী বিরাট সেখানে গৌণ। তাঁর বেশির ভাগটা জুড়েই থাকে খেলা।
অনেকেই আমায় অনেক সময়ে প্রশ্ন করেছেন, আমার বাবার জনপ্রিয়তার পিছনে তাঁর সুপুরুষ চেহারা কতটা ভূমিকা পালন করেছিল। সেক্ষেত্রে আমার বক্তব্য হল, শুধু চেহারা নয়, অনেক কিছুই কাজ করে জনপ্রিয়তার পিছনে। যাঁরা বাবাকে চেনেন, তাঁরা জানেন, উনি কতটা আকর্ষণীয় চরিত্রের মানুষ। যাঁরা ওঁর সঙ্গে কথা বলতেন, তাঁরাই ওঁর ভক্ত হয়ে যেতেন। আমরা, ওঁর মেয়েরা ছিলাম সবচেয়ে বড় ভক্ত। আসলে বাইরের সৌন্দর্য তো আপেক্ষিক একটা বিষয়, মানুষটা সুন্দর না হলে সবই বৃথা। সেটাই আসল কথা। ভিতরের এই সৌন্দর্যটা কোথা থেকে আসে? সততা থেকে। বাবা অত্যন্ত সৎ একটা মানুষ ছিলেন। আমার মনে হয়, কোনও খেলোয়াড় জনপ্রিয় হওয়ার পিছনে এটা খুব বড় একটা কারণ। হয়তো বিরাটও তেমনই। সেই কারণেই গোটা দেশের হৃদয় তিনি জয় করতে পেরেছেন।
(সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখন)