পুলক রায় চৌধুরীপ্রধান শিক্ষক, কনকনগর সৃষ্টিধর ইন্সটিটিউশন, সুন্দরবন-হিঙ্গলগঞ্জপহেলগাঁওয়ের মর্মান্তিক ঘটনাকে ঘিরে চারপাশের পরিস্থিতি বেশ উত্তপ্ত হচ্ছে দিন দিন। সাম্প্রদায়িকতার একটা চোরাস্রোত বইতে শুরু করেছে সর্বস্তরে। স্বাভাবিক নিয়মেই এর ঢেউ স্কুলের কচিকাঁচাদেরকেও আন্দোলিত করেছে। তাদের মধ্যে এই নিয়ে কথা হচ্ছে, হবে। কথার ভিত্তিতে তৈরি হতে পারে উষ্মা। আঘাত আসতে পারে অতি-সংবেদনশীল শিশুমনে। এমনকি সহপাঠীকে টিটকিরি করার মতো ঘটনাও ঘটে যেতে পারে। এই সময়েই শিক্ষকদের দায়িত্ব বেড়ে যায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে সজাগ দৃষ্টি মেলে বাড়তি কিছু উদ্যোগ নিতে হয়! মানবতাই যে মানুষের একমাত্র ধর্ম, এই কথা দৃঢ়ভাবে শিশুমনে প্রতিষ্ঠা করতে পারা শিক্ষকের সাফল্যের এক অন্যতম মাপকাঠি।সারা বছর ধরে বিভিন্ন অনুশীলনের মধ্যে দিয়েআমাদের স্কুলের কথাই বলি। সুন্দরবনের হিঙ্গলগঞ্জে অবস্থিত আমাদের কনকনগর সৃষ্টিধর ইন্সটিটিউশন। বর্তমানে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ১৪৭১। ছাত্রীদের সংখ্যা ছাত্রদের খানিক বেশি। পড়ুয়াদের মধ্যে সম্প্রীতির ভাবনা সারা বছর ধরে বিভিন্ন অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে গড়া তোলার নিরন্তর চেষ্টা করি আমরা। স্কুলের প্রার্থনা সভা থেকে শ্রেণিকক্ষের আনন্দ পাঠ, খেলাধুলার ক্লাস থেকে মিডডে মিল, টিফিন ব্রেক — স্কুলের বিভিন্ন পিরিয়ডের পরতে পরতে সম্প্রীতির বোধকে নির্মাণ-পুনর্নির্মাণের চেষ্টা চলে মাস্টারমশাইদের হাত ধরে।মিডডে মিল শুধু পুষ্টি-চর্চার ক্ষেত্র নয়প্রতিদিন চলা ক্লাস এইট পর্যন্ত মিডডে মিল শুধু পুষ্টি-চর্চার ক্ষেত্র থাকে না। মনন-চর্চার অপরিহার্য মাধ্যম হয়ে ওঠে। মিডডে মিলে থালার ক্রম যে প্রতিদিন সহপাঠীদের মধ্যে পাল্টে যায়, পাশাপাশি বসে ভাগ করে টিফিন খাওয়ার যে নিয়মিত অভ্যাস গড়ে ওঠে, তাতে সহনশীলতার পরিসর অনায়াসে ছাত্রছাত্রীদের ভিতর নির্মিত হতে থাকে। সকলে মিলেমিশে থাকা, খাওয়ার ধারণাকে প্রতিদিন এইভাবেই জারিয়ে দেওয়া হয় মিডডে মিলের সহজ অজুহাতে। অভ্যাসেই সম্প্রীতির বাঁধন পোক্ত হয়।স্কুলের চ্যালেঞ্জ, শিক্ষকদের চ্যালেঞ্জরাজ্য ও জাতীয় স্তরে নানা সময় আমরা নানা রাজনৈতিক ও জাতীয়তাবাদী ঘাত প্রতিঘাত তৈরি হতে দেখেছি। এখন তেমনই এক সময়। খবরের কাগজ, সোশাল মিডিয়া ইত্যাদি নানা মাধ্যম হয়ে আমাদের বাচ্চাদের কাছে সেই ঘাত প্রতিঘাতের সংবাদ এসে পৌঁছায়। কিন্তু স্কুল পরিসরে এই অভিঘাতকে সুচিন্তিতভাবে সঠিক পথে চালনা করতে পারাটাই স্কুলের চ্যালেঞ্জ, শিক্ষকদের চ্যালেঞ্জ। স্কুলের নানারকম কার্যকলাপ, প্রকল্পের মধ্যে দিয়ে সম্প্রীতির মূল ভাবটাকে বজায় রাখার চেষ্টা চলতে থাকে। তাই খবর পৌঁছালেও সাম্প্রদায়িকতার কলূষিত বিষবাষ্প ওদের মনের কাছকাছি পৌঁছাতে পারে না।বিপরীত দৃষ্টান্তই তৈরি করছে কচিকাঁচারাপরিস্থিতি যখন উদ্বেগজনক, তখন এই ধরনের প্রচেষ্টাগুলো আরও বাড়িয়ে দিতে হয়। বর্তমানে সেটাই আমাদের স্কুলে হচ্ছে। গরমকাল পড়ে গিয়েছে বলে ছাত্রছাত্রীদের একটা সামার প্রোজেক্ট করতে হয়। প্রোজেক্টটি করতে কয়েকজন পড়ুয়ার একটি করে দল তৈরি করে দেওয়া হয়। এই দল তৈরির সময় যাতে কোনওরকম বিভাজন না হয়, সেদিকে নজর রাখছেন বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকারা। একটা গ্রুপের মধ্যে কাজ করতে করতে প্রত্যেকের মধ্যে একতার বোধ শক্তপোক্ত করে তোলাই উদ্দেশ্য। আশেপাশে প্রতিনিয়ত বিভাজনের চেষ্টা ওদেরও চোখে পড়ছে। কিন্তু ভেদাভেদ ভুলে এই পরিস্থিতিতে দল বেঁধে কাজ করার মধ্যে দিয়ে বিপরীত দৃষ্টান্তই তৈরি করছে স্কুলের কচিকাঁচারা।বিভাজনকে হেলায় উড়িয়ে দিয়েছে খুদেরাএকটা সুন্দর অভিজ্ঞতা এই প্রসঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যাক। এই কিছুদিন আগেই স্কুল থেকে সব ছাত্রছাত্রীদের কলকাতার ইডেন গার্ডেন ক্রিকেট স্টেডিয়ামে আইপিএল দেখাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ধর্মের নিরিখে ভিন্ন বিশ্বাসে হাঁসফাঁস করা এই সমাজ যখন একে অপরকে আড় চোখে দেখছে, আমাদের পড়ুয়ারা সেই ভেদাভেদের লেশমাত্র বহন না করেই তাদের পছন্দের টিমকে সাপোর্ট করেছে, একে অপরের গালে এঁকে দিচ্ছে ব্যক্তিগত পছন্দের দলের নাম। যে বিভাজন মানুষকে নিয়ত অস্তিত্ব সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, সেই বিভাজনকে হেলায় উড়িয়ে দিয়েছে খুদে সমর্থকদের সম্মিলিত উৎসাহব্যঞ্জক চিৎকার।নানাভাবে পৌঁছে দেওয়া ইতিবাচক বার্তাস্কুলের করিডরে, দেওয়ালে যেসব ম্যুরাল আঁকা রয়েছে তার বেশিরভাগই মানবতা নিয়ে নানা বার্তা ও সম্প্রীতির প্রতিচ্ছবি। ফলে সারা বছর যখন ওই করিডর দিয়ে আমাদের ছাত্রছাত্রীরা হাঁটাহাঁটি করে ও ম্যুরালগুলি বারবার দেখে, স্বাভাবিকভাবে তাদের মনে একটা ইতিবাচক বার্তা পৌঁছায়।জাতীয় সংগীতের পরবর্তী অনুচ্ছেদভারতের জাতীয় সংগীতের প্রথমাংশটুকুই সাধারণত গাওয়ার রীতি। কিন্তু এর পরবর্তী অনুচ্ছেদগুলোর মধ্যে যে ছত্রে ছত্রে রয়েছে সম্প্রীতির বার্তা তা মাঝে মাঝেই স্কুলের অডিয়ো সিস্টেমে বাজানো হয়। পড়ুয়াদের মর্মে সম্প্রীতির বার্তা প্রতিদিন এভাবেই পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা চলে।অ্যাক্টিভিটি ও প্রোজেক্টের মধ্যে দিয়েআমার মনে হয়, ক্লাসে স্যররা বলছেন বা প্রার্থনাসংগীতের সময় কথা বলে ওদের বোঝানো হচ্ছে, এই পদ্ধতির বদলে যদি আরও কিছু অ্যাক্টিভিটি ও প্রোজেক্টের মধ্যে দিয়ে সম্প্রীতির বার্তা পৌঁছে দেওয়া যায়, তবে তা আরও বলিষ্ঠ হয়, তাদের শিশুমনে চিরস্থায়ীভাবে গেঁথে থাকে এবং থাকবে।স্কুল সমাজেরই ছোট সংস্করণসব ধর্মের মানুষকে নিয়েই আমাদের দেশ ভারতবর্ষ, স্কুল তার দর্পণ মাত্র। স্কুল সমাজেরই ছোট সংস্করণ, যেখানে বিভিন্ন বয়সের, বিভিন্ন অর্থনৈতিক স্তরের ও বিভিন্ন বিশ্বাসের পড়ুয়ারা একসঙ্গে পড়াশোনা করে, শেখে, হইহই করে বাঁচে। খেলার মধ্যে দিয়েও এই ঐক্যবদ্ধ রূপকে নিয়মিত ধরে রাখার চেষ্টা চলে। আমাদের স্কুলে যখন খোখো, ভলিবল খেলা হয়; আত্মরক্ষার জন্য ক্যারাটে শেখানো হয়, সবক্ষেত্রে শিক্ষকরা টিম তৈরি করে দেন না। ছাত্রছাত্রীদের নিজেরা টিম তৈরি করার স্বাধীনতা পায়। এই যে সারা বছর সম্প্রীতির চর্চা চলে তার বহিঃপ্রকাশ হিসাবে, আমাদের এই ছাত্রছাত্রীরাই কোনওরকম ভেদাভেদের চিহ্ন তাদের নিজেদের দল নির্বাচনে যে রাখে না —এটাই সেই সফলতা। মানুষে মানুষে ধর্মের, জাতের বিভাজন ভুলে মানুষের গুণটাকে যে ওরা বড় করে দেখছে —এটাই আগামী সমাজের জন্য ইতিবাচক পাঠ।চেষ্টা করে চলাই কর্তব্যদু-এক মাস পর বর্ষা নামবে। উত্তপ্ত আবহাওয়া বোধ করি কিছুটা প্রশমিত হবে। তখন অনেক গাছ লাগানো শুরু করবে ওরা। তার জন্য এখন থেকেই কিন্তু বীজ তৈরির প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে। ওরা জেনে গিয়েছে, ভালো বীজ, ভালো উদ্ভিদের জন্ম দেবে। তাই স্কুলের প্রচেষ্টায় ওরা বীজ-সংরক্ষণ করছে, সীড-বল বানিয়ে রাখছে। এক্ষেত্রেও কোনওরকম বিভাজন বা ভেদাভেদকে প্রশ্রয় দিয়ে নয়, মানুষের গ্রুপ তৈরি করেছে ওরা। অশান্ত এই পরিস্থিতিতে ওদের পাশে থেকে নির্বিষ ভাবনাগুলোকে নিয়মিত উৎসাহ জোগানোও কিন্তু একজন শিক্ষকেরই কর্তব্য। আমরা সেই চেষ্টাই করে চলেছি, সেই চেষ্টা করে চলাই আমাদের সকলের কর্তব্য।প্রবন্ধের বক্তব্য লেখকের নিজস্ব(অনুলিখন - সংকেত ধর)