আগেকার দিনে রাজা-মহারাজার স্নানপর্বে গীতবাদ্য বা মঙ্গল বাদ্যের বেশ প্রচলন ছিল। যা অত্যন্ত প্রাচীন, রামায়নে আছে রামচন্দ্রের অভিষেক অনুষ্ঠানে জাতিরাগ পরিবেশিত হয়েছিল। সঙ্গতে ছিল বীণা এবং মৃদঙ্গ। এইরকম সংগীতময় পরিবেশে কলসের জল ঢেলে শ্রী রামচন্দ্রের অভিষেক সম্পন্ন হয়েছিল।
এরপর শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থেও স্নান পর্বে বাদ্যযন্ত্রের উল্লেখ পাওয়া গেছে। একবার শ্রী চৈতন্যদেব দক্ষিণাত্যে গোদাবরী ঘাটে স্নান করে কৃষ্ণ নাম করছেন। এমন সময় সেখানে এলেন রামানন্দ রায় স্নান পর্বের জন্য। বাজনা বাজিয়ে স্নানে আসাটাই তখনকার দিনে রীতি ছিল।
দুর্গাপুজো ছিল রাজা জমিদারদের পুজো, তাই দেবীর স্নানপর্বে শুধু বাজনা নয় নির্দিষ্ট রাগের সঙ্গে নির্দিষ্ট বাদ্য যন্ত্রর নিয়মও বেঁধে দেওয়া হয়েছিল।
প্রথমে পঞ্চগব্য এবং পঞ্চমৃত দিয়ে মায়ের উদ্দেশ্যে স্নান মন্ত্র উচ্চারণ করা হয়। এরপর বেশ্যা দ্বার থেকে রাজ দ্বার পর্যন্ত সমস্ত রকমের মাটি মা দুর্গার উদ্দেশ্যে মন্ত্র পাঠ করে লেপন করা হয়। মৃত্তিকা দিয়ে স্নানের পর আটটি রাগ আট রকমের বাদ্যযন্ত্রসহ শুরু হয় অষ্ট কলস স্নান পর্ব। এই অষ্টকলস স্নান পর্বে ৮ রকমের জলও নির্দিষ্ট থাকে সঙ্গে থাকে আট টি মন্ত্র।
কিন্তু এখনকার দিনে দুর্গাপূজায় অষ্টকলস স্নান পর্বে রাগ আলাপ সহ বাদ্যযন্ত্রের প্রথা অবলুপ্ত হয়ে গেছে। দুর্গাপুজোর ক্ষেত্রে সেই আটটি রাগের ধ্যান মন্ত্র পাওয়া যায়। সেই রাগগুলি সঙ্গে যে বাদ্যগুলি পরিবেশন করা হয় তার ক্রমতালিকায় এরকম- মানব রাগের সঙ্গে বিজয় বাদ্য। ললিত রাগে দেবদাদ্য। বিভাস রাগের সঙ্গে দুন্দুভি বাদ্য। ভৈরব রাগের সঙ্গে ভীম বাদ্য, কেদার রাগে ইন্দ্রাভিষেক বাদ্য, বরাটী রাগে শঙ্খ বাদ্য, বসন্ত রাগে পঞ্চ শব্দ বাদ্য, সব শেষে ধানেশ্রী রাগে ভৈরব বাদ্য। আজ পুজো মণ্ডপ গুলিতে যেমন রাগের সঙ্গে বাদ্যের প্রচলন নেই তেমনি অনেক রাগ সঙ্গীতের আসর থেকেও লুপ্ত হয়ে গেছে।
এই রাগ গুলির মধ্যে বিলুপ্তপ্রায় রাগ হল মালব, বরাটী ও ধানেশ্রী। ভারতের প্রাচীন মালব জাতির থেকে এসেছে মালব রাগটি। বরাটী রাগ সম্ভবত মহাভারতের বিরাট দেশ থেকে এসেছে। অনেক জায়গায় এই ডাকটিকে বরারি, বৈরটিকা ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়।
আর সবশেষে আসে ধানেশ্রী রাগ। এই রাগের শেষে আছে শ্রী, শ্রী মানে কিন্তু আমরা দেবী লক্ষীকে বুঝি। এই রাগ শ্রী বৃদ্ধিকারী ধান ও লক্ষীর মধ্যে সংযোগের বার্তা বহন করে তাই দেবী দুর্গার স্নান পর্বের শেষ তম কলসে এই রাগ গাওয়ার হয়তো বিধান দেওয়া হয়েছে।
দুর্গা পুজোয় নবপত্রিকা বা কলা বৌ কে দেবী রূপে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। নবপত্রিকার মধ্যে থাকে ন রকমের পত্র বা পাতাযুক্ত গাছ তার মধ্যে একটি হলো ধান গাছ। শেষে নবপত্রিকা বিসর্জন হয় ঠিকই কিন্তু ধান গাছ টি বিসর্জন হয় না। তাকে ফিরিয়ে আনা হয় ঘরে। এই গাছ টিকে মা ভগবতী রূপে কল্পনা করে ঘরে আনা হয় ফিরিয়ে। এই রাগের সঙ্গে ভৈরব বাদ্য সংযুক্ত। ভৈরব বাদ্য শিব রূপের অন্যতম প্রকাশ। এই সুর শিবশক্তির মিলনকে সূচিত করে সঙ্গে থাকে ভৈরব বাদ্যর সঙ্গত।
এইভাবে অষ্ট কলসের মাধ্যমে দেবীর স্নান পর্ব সমাপ্ত হয়। যেখানে থাকে আটটি সুর, আট রকম বাদ্যযন্ত্র ও অষ্ট প্রকার জল। তবে এই স্নান বিধি কিন্তু দেবী পুরাণে কোথাও উল্লেখ নেই, কালিকাপুরাণের বিধিতে এই স্নান পর্বের কথা উল্লেখ রয়েছে।