আমদাবাদ বিমান বিপর্যয়ের ৩০ দিনের মাথায় শুক্রবার রাতে প্রকাশ্যে এসেছে প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্ট। তাতে ককপিটের ফুয়েল কাট অফ স্যুইচ বন্ধ করাকে এই দুর্ঘটনার কারণ হিসাবে দায়ী করা হয়েছে। আর সেই সেই রিপোর্টে যা জানানো হয়েছে তাতে সমাধানের বদলে আরও গাঢ় হয়েছে রহস্য। প্রশ্ন উঠছে, কে বন্ধ করল ফুয়েল কাট অফ স্যুইচ? কারণ অভিজ্ঞ পাইলটরা জানাচ্ছেন, ভুল করে এই স্যুইচ বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব নয়। নিজে থেকেও বন্ধ হয় না এই স্যুইচ। তাও আবার একসঙ্গে ২টো। তবে কি আসন্ন পরিণতি জেনেও এই মোক্ষম সময় স্যুইচ ২টি বন্ধ করে দিয়েছিলে ২ পাইলটের কেউ?
রিপোর্টে জানানো হয়েছে, আমদাবাদের সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল বিমানবন্দর থেকে টেক অফ করার কয়েক সেকেন্ড পরেই বিমানের ফুয়েল কন্ট্রোল স্যুইচ বন্ধ করে দেন ২ পাইলটের কেউ। সঙ্গে সঙ্গে অন্যজন চিৎকার করে ওঠেন, ‘আপনি এই স্যুইচ বন্ধ করলেন কেন?’ জবাবে অন্য পইলট বলেন, ‘আমি এই কাজ করিনি’। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে স্যুইচ ২টিকে ফের চালু অবস্থায় ফেরানো হয়। কিন্তু জেট ইঞ্জিন একবার বন্ধ হয়ে গেলে ফের চালু হতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগে। স্যুইচ অন করার পরে ইঞ্জিন চালু হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হলেও তা বিমানকে প্রয়োজনীয় শক্তি যোগাতে পারেনি। ফলে মাটিতে আঘাত করে বিমানটি।
আকাশে থাকাকালীন বিমানের ইঞ্জিন কোনও কারণে নিজে থেকে বন্ধ হয়ে গেলে, বা ইঞ্জিনে কোনও ভাবে আগুন লেগে গেলে তবেই ফুয়েল কাট অফ স্যুইচ বন্ধ করেন পাইলটরা। কিন্তু এক্ষেত্রে ফুয়েল কাট অফ স্যুইচ বন্ধ করার আগে বিমানের ২টি ইঞ্জিন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ভাবেই চলছিল। তাহলে কেন বন্ধ করা হল ফুয়েল কাট অফ স্যুইচ? আধুনিক যে কোনও বিমানের ২টি ইঞ্জিনের মধ্যে যে কোনও ১টি চালু থাকলেই বিমানটি উড়তে পারে। এক্ষেত্রে ২টি ইঞ্জিনের ফুয়েল কন্ট্রোল স্যুইচ প্রায় একসঙ্গে বন্ধ করে দেওয়ার উদ্দেশ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
এই রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসার পর একাধিক প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। প্রথমত, ২ পাইলটের মধ্যে কথোপকথনের উল্লেখ থাকলেও কে কোন কথা বলেছেন তার উল্লেখ নেই। রিপোর্টে ২ জনকেই ‘পাইলট’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে ‘স্যুইচ বন্ধ করলেন কেন’ প্রশ্নটি কে করেছেন তা স্পষ্ট নয়। তবে রিপোর্টে জানানো হয়েছে ফার্স্ট অফিসার ক্লাইভ কুন্দর বিমানটি চালাচ্ছিলেন। ক্যাপ্টেন সুমিত সবরওয়াল নজরদারির দায়িত্বে ছিলেন। বিমানটির ম্যানুয়াল টেক অফ হয়েছিল। যা স্বাভাবিক বলে জানাচ্ছেন অভিজ্ঞ পাইলটরা। সঙ্গে তাঁরা এ-ও জানাচ্ছেন, উড়ানের এই প্রাথমিক পর্যায়ে ২ পাইলটের মধ্যে যিনি বিমানটি ওড়ানোর দায়িত্বে থাকেন তাঁকে অত্যন্ত একাগ্রতার সঙ্গে সামনের সমস্ত যন্ত্রের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। ফলে তাঁর পক্ষে ফুয়েল কাট অফ স্যুইচ বন্ধ করা খুবই অস্বাভাবিক। তবে কি ক্যাপ্টেন সবরওয়াল ওই স্যুইচ বন্ধ করেছিলেন? জবাব নেই রিপোর্টে।
ক্যাপ্টেন সবরওয়াল একজন অত্যন্ত অভিজ্ঞ পাইলট। নিজের পেশাদারি জীবনের প্রায় শেষ লগ্নে এসে পৌঁছেছিলেন তিনি। টেক অফের ঠিক পরে ফুয়েল কন্ট্রোল স্যুইচ বন্ধ করলে কী পরিণতি হতে পারে তা বিলক্ষণ জানা ছিল তাঁর। ফলে তিনি এই কাজ ভুল করেও করে থাকবেন সেটাও অত্যন্ত অস্বাভাবিক।
এছাড়া হাতের ধাক্কা লেগে বা কোনও কিছু পড়ে ফুয়েল কাট অফ স্যুইচ বন্ধ হয়ে যাওয়াও প্রায় অসম্ভব। কারণ এই স্যুইচগুলি এমন ভাবে বানানো যাতে অন বা অফ করতে গেলে প্রথমে স্যুইচটিকে টেনে ওপরের দিকে তুলতে হয়। তার পর সামনে বা পিছনে ঠেলে অবস্থান বদলাতে হয়। হাত লেগে বা কোনও কিছু পড়ে স্যুইচ বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
এছাড়া এই স্যুইচ নিজে থেকে অবস্থান বদলাতে পারে না। বিমানে বেশ কিছু স্যুইচ থাকে যা নিজে থেকেই অবস্থান বদলাতে পারে। এই স্যুইচগুলি তেমন নয়। এতে নিজে থেকে অবস্থান বদলানোর কোনও ব্যবস্থা নেই। সচেতনভাবে নিজে হাতে স্যুইচগুলিকে বন্ধ করতে হয়। ফলে কেউ না কেউ স্যুইচ বন্ধ করেছিলেন তা একপ্রকার নিশ্চিত। টেক অফের পর বিমান ১০০০ ফুট উচ্চতায় না ওঠা পর্যন্ত সাধারণত পাইলটরা ল্যান্ডিং গিয়ার বন্ধ করা ছাড়া কোনও স্যুইচ স্পর্শ করেন না। প্রশ্ন হল তাহলে কি টেক অফের ঠিক পরে জেনে বুঝেই ফুয়েল কাট অফ স্যুইচ বন্ধ করে দিয়েছিলেন ২ পাইলটের কেউ?
অভিজ্ঞ পাইলটরা জানাচ্ছেন, ককপিটে এত স্যুইচ থাকে যে অনেক সময় নবীশ পাইলটরা একটা স্যুইচ বন্ধ করতে গিয়ে অন্য স্যুইচ বন্ধ করে ফেলেন। যেমন কিছু ক্ষেত্রে ল্যান্ডিং গিয়ার বন্ধ করতে গিয়ে অনেকে ফ্ল্যাপ বন্ধ করে দেন। কিন্তু বিমানের ল্যান্ডিং গিয়ারের স্যুইচ বন্ধ অবস্থাতেই পাওয়া গিয়েছে। তবে ঠিক তার পরেই ২টি ইঞ্জিনই বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিমানে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ল্যান্ডিং গিয়ার আর বিমানের ভিতরে প্রবেশ করেনি। আর ল্যান্ডিং গিয়ার বন্ধ করতে গিয়ে ফুয়েল কাট অফ স্যুইচ বন্ধ করে দেওয়াও অসম্ভব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া বৈদ্যুতিন কারণে ফুয়েল কাট অফ স্যুইচ অন থাকলেও সফটওয়্যারের ভুলে ২টি ইঞ্জিন একসঙ্গে বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও বিরল বলছেন তাঁরা। আর এক্ষেত্রে যে তেমন কিছু ঘটেনি তা বলছে ফ্লাইট ডেটা রেকর্ডারের তথ্য। সেখানে স্পষ্ট দেখা গিয়েছে, বন্ধ করে ফের চালু করা হয়েছিল ফুয়েল কাট অফ স্যুইচ।
যে স্যুইচ উড়ান চলাকালীন বন্ধ করারই কথা নয়, নিজে থেকে বন্ধ হয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, উড়ানের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে সেই স্যুইচ বন্ধ করা হল কেন? বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, আর কয়েক সেকেন্ড পরে যদি ওই স্যুইচ ২টি বন্ধ হত তাহলেও বিমানটিকে বাঁচানোর জন্য কিছুটা সময় থাকত। কিন্তু স্যুইচগুলি এমন সময় বন্ধ করা হয়েছে যাতে সেটির চরম পরিণতি আসন্ন ছিল।
সব শেষে প্রশ্নের মুখে পড়েছে পাইলটদের মানসিক স্বাস্থ্য। প্রায় ১১ বছর আগে ঘটা মালেশিয়ান এয়ারলাইন্সের বিমান MH 370র অন্তর্ধান রহস্যের মতো এখানেও প্রশ্নের মুখে পড়ছে পাইলটদের ভূমিকা। তবে কি মানসিক অস্থিরতার কারণে পরিণতি জেনেও টেক অফের ঠিক পরে ফুয়েল টেক অফ স্যুইচ বন্ধ করে দিয়েছিলেন ২ পাইলটের কোনও একজন? এই প্রশ্নের জবাব পেতে গেলে ২ পাইলটের ব্যক্তিগত জীবন খতিয়ে দেখতে হবে তদন্তকারীদের।