HT Bangla Special: সকাল ১১ টা বেজে ১৭ মিনিট। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক্স হ্যান্ডেল থেকে পোস্ট — সকাল নটায় প্রয়াত হয়েছেন সোনারপুরের প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক জীবন মুখোপাধ্যায় — সেই মর্মে শোকবার্তা। বিধায়ক হিসেবে জনহিতকর নানা কাজ করলেও সিংহভাগ বাঙালি জীবন মুখোপাধ্য়ায়কে মনে রেখেছে ইতিহাসবিদ হিসেবেই। আরেকটু সরল ও নির্দিষ্ট করে বললে ইতিহাসের পাঠ্যবই লেখক হিসেবে। শুধু স্কুলে নয়, ডিগ্রি কোর্সেও পাঠ্য ছিল তাঁর বই। ফলে বাঙালি ছাত্রজীবনের বেশ কিছুটা জুড়েই জীবনবাবু। পাঠ্য হিসেবে কেমন লাগত তাঁর ইতিহাস বই? কতটা সহজ বা কঠিন? শিক্ষক হিসেবেই বা জীবন মুখোপাধ্যায়ের বই ক্লাসে পড়ানোর অভিজ্ঞতা কেমন? হিন্দুস্তান টাইমস বাংলায় নানা আঙ্গিকে তাঁকে স্মরণ করলেন পড়ুয়া, শিক্ষক, প্রকাশক ও নিত্য অফিসযাত্রী বাঙালিরা।
‘যে কোনও সংশয়ে ভরসা ছিলেন জীবনবাবু’
দীর্ঘ দিন হিন্দু স্কুলে ইতিহাসের শিক্ষকতা করেছেন সুগত মিত্র। অবসরপ্রাপ্ত বর্ষীয়ান শিক্ষকের কথায়, ‘জীবন মুখোপাধ্যায়ের বই ভীষণ তথ্যসমৃদ্ধ। আমরা অন্য বইতে যা পেতাম না, জীবনবাবুর বইতে তা পেতাম। ইতিহাস নিয়ে সাম্প্রতিককালে যা যা গবেষণা হচ্ছে, সেগুলি তাঁর নখদর্পণে থাকত। সে তথ্য উঠেও আসত পাঠ্যবইয়ের পাতায়। ফলে তাঁর বইয়ে ভুল তথ্য থাকত না বললেই চলে। মাধ্যমিক থেকে ডিগ্রি স্তর পর্যন্ত সবক্ষেত্রেই তাঁর বইকেই শেষ কথা বলে মনে করতাম আমরা। ফলে ছাত্রদের বারবার জীবন মুখোপাধ্যায় রেকমেন্ড করেছি। ইতিহাসের কোনও তথ্য নিয়ে সংশয় তৈরি হলে যাচাই করার জন্যও জীবনবাবুর বই রেফার করতাম।’

‘ভীষণ মাটির মানুষ’
স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস নিয়ে দীপ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে জীবন মুখোপাধ্যায়ের একটি বই। প্রকাশক দীপ্তাংশু মণ্ডল জানাচ্ছেন,‘স্যরের সঙ্গে দীর্ঘ দিনের পরিচয়। মাধ্যমিক থেকে ডিগ্ৰি কোর্স, সব স্তরেই ওঁর বই ব্যাপক জনপ্রিয়। আমি নিজেও ওঁর বই পড়েছি, মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছি। ভাবিনি কখনও ওঁর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাব। কিন্তু পেয়েছি। ভীষণ মাটির মানুষ জীবনবাবু। সপ্তাহে কিছু না হলেও তিন দিন ফোন করতেন। নানা বইয়ের বিষয়ে আলোচনা করতেন। সকাল সকাল এই খবর পেয়ে প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি। খুব শোকাহত। ওঁর আরও একটি বইয়ের কাজ চলছিল। সেটা আর হয়ে উঠল না!’
‘আমাদের ছেলেবেলার স্থপতি’
দীপ প্রকাশনে বই সম্পাদনার সুবাদে গৌরব অধিকারী দীর্ঘ সান্নিধ্য পেয়েছেন জীবন মুখোপাধ্যায়ের। তাঁর কথায়, ‘অত বড় মাপের মানুষ এত বিনম্র, বিনয়ী হতে পারে, ভাবা যায় না। নানা বিষয়ে আমাদের কথা হত। ওঁর ছোটবেলার গল্প বলতেন। আমাদের শৈশব-কৈশোরের নানা জিনিসই তো ধীরে ধীরে অবলুপ্তির পথে। উনি আমাদের ছেলেবেলার স্থপতি ছিলেন। আজ উনিও লোকান্তরিত হলেন। তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছি, এ আমার সারা জীবনের সঞ্চয়।’
‘শিক্ষকদের মধ্যেও জনপ্রিয়’
তাঁর বই সম্পাদনার অভিজ্ঞতা কেমন? গৌরবের কথায়, ‘স্যর এত নিপুণভাবে পুরো বিষয়টি লিখে সাজিয়ে দিয়েছিলেন যে আমাদের সম্পাদনার কোনও জায়গা ছিল না।। সত্যি বলতে আমাদের শুধু অধ্যায় সাজিয়ে প্রুফ দেখে দেওয়া ছাড়া আর কোনও কাজ ছিল না। ‘স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস’ বইটা একবার কিছুদিনের জন্য আউট অব প্রিন্ট হয়ে যায়। জেলা থেকে বহু শিক্ষককে এসে খোঁজ করতে দেখেছি। শুধু ছাত্রছাত্রী নয়, ইতিহাসের শিক্ষকদের তিনি ভীষণ জনপ্রিয় ছিলেন। এমন হঠাৎ প্রয়াণে খুবই শোকাহত। ওঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।’

‘ওঁর বই পড়লে ছোট প্রশ্নের উত্তর লেখা খুব সহজ’
২০২৩ সালের উচ্চমাধ্যমিকে সপ্তম স্থান অধিকার করেছিলেন রূপান্তরকামী স্মরণ্যা ঘোষ। মেধা ও রূপান্তরিত হওয়ার ‘ইচ্ছে’ তাঁকে খবরের শিরোনামে আনে। কথায় কথায় স্মরণ্যাও বললেন ইতিহাস বিষয়ে তাঁর ভরসার লেখক জীবন মুখোপাধ্যায়। ‘আমি জীবন মুখোপাধ্যায়ের বই-ই পড়তাম। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকে শর্ট কোশ্চেনে প্রচুর নম্বর থাকে। ফলে সেখানে নম্বর তোলার একটা বড় সুযোগ থাকত। ওঁর বইয়ের প্রচুর তথ্য়ে ভরপুর। তাই ছোট প্রশ্নের উত্তর লেখার ব্যাপারে কোনও অসুবিধা হয়নি। ওই বইগুলি পড়ে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকে খুব উপকৃত হয়েছিলাম।’
‘তিনিই বোঝালেন ইতিহাস রোমহর্ষক গল্পকথা’
পেশায় ডায়েটিশিয়ান জয়িতা ব্রহ্ম। কর্মসূত্রে ইতিহাসের সঙ্গে কোনও যোগ নেই। কিন্তু ইতিহাস বইয়ের কথা বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে জীবন মুখোপাধ্যায় লেখা বইয়ের মলাট। ‘স্কুলে পড়াকালীন আর পাঁচজনের মতোই ইতিহাসভীতি ছিল। কিন্তু জীবন মুখোপাধ্য়ায়ের বই পড়ে মনে হত ইতিহাস শুধু মুখস্থ করার বিষয় নয়। ইতিহাস রোমহর্ষক গল্পকথা। ওঁর বইয়ে বিভিন্ন সভ্যতার কথাও এত সুন্দর লেখা থাকত যে মনে হত সেই সময়টায় ফিরে গিয়েছি। প্রয়াণের খবর পাওয়া ইস্তক মনখারাপ খুব।’
‘ইতিহাস-ভীতি কাটিয়ে দিয়েছিলেন’
ইতিহাস মুখস্থ করার বিষয় নয়। এটা যেন প্রথম চেনালেন জীবন মুখোপাধ্য়ায়। ডাংনা পশ্চিমপাড়া প্রাইমারি স্কুলের সহশিক্ষক অরিন্দম মালাকার কথায় সেই সুর। ‘আমাদের সময়ে তো ইতিহাস বই মানেই ওঁর বই বুঝতাম। আর কোনও লেখকের নামও জানতাম না। ইতিহাস-ভীতি কাটিয়ে বিষয়টাকে ভালোবাসতে, মুখস্তর বদলে আত্মস্থ করতে শিখিয়েছিল জীবন মুখোপাধ্যায়ের ইতিহাস বই। ইতিহাস আর জীবন মুখোপাধ্যায় যেন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত — একই মুদ্রার দুই পিঠ। তারাদের দেশে ভালো থাকুক আমাদের ছোটবেলার স্যর।’

‘ডব্লুবিসিএস-এ ওঁর বই পড়তাম’
নির্বাচন কমিশনে কর্মরত বছর পঁয়ত্রিশের সৌম্যতান পাল। কথায় কথায় সৌম্যতান জানালেন, ‘ ইতিহাস নিয়ে খুব গভীর আলোচনা ছিল পাঠ্যবইয়ে। ক্লাস নাইন-টেনে তাই একেবারেই ভালো লাগত না। পরে যখন ইতিহাসকে ভালোবাসা শুরু হল, ওঁর হাত ধরেই হল। ডব্লুবিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার সময় ওঁর বই পড়তাম। পড়তে পড়তে দেখেছি, একটা মানুষ ইতিহাস নিয়ে কত গভীর পড়াশোনা করলে এভাবে ইতিহাস উপস্থাপন করতে পারেন। আমার মনে হয় বাঙালি ছাত্রদের কাছে জীবন মুখোপাধ্যায় ইতিহাসে জীবন দিয়েছেন।’
‘ইতিহাসই তাঁকে অমর করে রাখবে’
চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন দমদমনিবাসী শৌভিক সরকার। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার একটি বিষয় ইতিহাস। শৌভিকের কথায়, ‘স্কুলে প্রথম ধাপের ইতিহাস পড়ার হাতেখড়ি হয়েছিল জীবন মুখোপাধ্যায়ের বই দিয়ে। এরপর কলেজেও ইতিহাস পড়ার ক্ষেত্রে যার বই একমাত্র পাথেয় হল তাঁর নাম জীবন মুখোপাধ্যায়। চাকরিপ্রার্থীদের জন্য বাংলা ভাষায় ইতিহাস পড়ার সর্বোৎকৃষ্ট এবং নির্ভরযোগ্য বই হিসেবে তালিকার শীর্ষে থাকবে জীবনবাবুর লেখা বই। কাগজে কলমে তিনি আজ ইতিহাসে চলে গেলেও, তাঁর লেখা ইতিহাস বই-ই তাকে ইতিহাসের অমর পাতায় ঠাঁই করে দিল — এ ইতিহাস মুছে যাবে না।’