অপেক্ষা ছিলই…, বহুদিন পর আরও একবার বড়পর্দায় কেন্দ্রীয় চরিত্রে হয়ে ফিরলেন অনন্যা চট্টোপাধ্যায়। ছবির প্রেক্ষাপট কলকাতা ও লন্ডন হলেও আদ্যপ্রান্ত বাঙালিয়ানায় ভরপুর একটা গল্প। কাহিনী ছিমছাম হলেও মা 'অন্নপূর্ণা'র চরিত্রটি অনেককিছু শিখিয়ে দিয়ে যায়। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য বয়স কোনও বাধা নয়, আবার দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি দিয়ে অনেক কঠিন পথ জয় করার অনুপ্রেরণা যোগায় এই 'অন্নপূর্ণা'র গল্প।
গল্প শুরু হয় পুরোনো ঐতিহ্যবাহী দেবশর্মা বাড়ির দুর্গাপুজোর পটভূমিতে। পুজো শুরু হবে, তাই স্নান সেরে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বাড়ির কর্ত্রী অন্নপূর্ণা। সুন্দর সেই আবহে রয়েছে স্বামীর সঙ্গে অন্নপূর্ণার প্রেমালাপ ও অল্পবিস্তর খুনসুটি। যদিও সেই প্রেমের গল্পে ছোট্ট একটা টুইস্ট আছে, তবে সেটা এখানে নাইবা ফাঁস করলাম। এদিকে বাড়ির পুজোয় দুবছর পর কলকাতায় ফেরে দসশর্মা বাড়ির মেয়ে আনন্দী, সঙ্গে জামাই অতনু। পুজোর কটাদিন আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে বেশ হইহই করে কেটে যায়। এবার আনন্দীর লন্ডনে ফেরার পালা, তবে এবার সে একপ্রকার জোর করেই নিজের মাকেও বেশকিছুদিনের জন্য সঙ্গে করে নিয়ে যায় লন্ডনে।
বেশকিছুদিন লন্ডনে মা-জামাই-এর সঙ্গে দিব্যি কাটছিল 'অন্নপূর্ণা'র জীবন। তবে ধীরে ধীরে পরিবেশ-পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে যেতে লাগল। এই পরিস্থিতিতে অন্নপূর্ণার সঙ্গে আলাপ হল রনির। যে কিনা কলকাতা থেকে লন্ডনে ছুটে গিয়েছে নিজের প্রেম নিকোলকে কাছে পেতে। তবে সেখানে গিয়ে জীবিকার তাড়নায় শুরু হয়েছে রনির লড়াই। তবে ঘটনাচক্রে রনি ও নিকোলের সঙ্গে জুড়ে যান অন্নপূর্ণাও, বলা ভালো অন্নপূর্ণার মাতৃত্বই তাঁদের কাছাকাছি আনে। আবার রনির হাত ধরেই ভিনদেশে গিয়ে এই প্রবীণা অন্নপূর্ণা জীবনে শুরু হয় কর্মজীবন ও নিজস্ব পরিচয় তৈরির এক অন্যরকম লড়াই। ঘটনাচক্রে তাঁদের সঙ্গে জুড়ে যান বি বি অর্থাৎ বিনয় বিশ্বাস। তিনিও প্রবাসী বাঙালি। এরপর গল্প নানান চড়াই উৎরাই পথ পার করে নিজস্ব চলন ভঙ্গীতে এগিয়ে চলে।
এর থেকে বেশিকিছু বলে দিলে হলে গিয়ে ছবি দেখার মজাটাই চলে যাবে, তা বাকিটা থাকনা…।
ছবির গল্প তো মোটামুটি বোঝা গেল, তবে চিত্রনাট্যে যে খুব কঠিন বা জটিল, তেমনটা এক্কেবারেই নয়। এক্কেবারেই ছিমছাম সহজ-সরল বাংলা বাঙালির ভাবাবেগকে কাজে লাগিয়েই গল্প লেখা। ছবির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রয়েছে আবেগের মোটা একটা প্রলেপ। আর সেন্টিমেন্ট-ই এই ছবির মূল রসদ, কারণ এটাই আপনাকে ছবির সঙ্গে জুড়ে রাখবে। আবার কখনওবা সিনেমা দেখতে দেখতে নিজের অজান্তেই আবেগের ফল্গু ধারায় চোখের পাতাও হয়তবা ভিজে যাবে। তবু খামতি কি নেই? আছে বৈকি। যেমন মেয়ে জামাইকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে তাঁদেরই বাড়িতে অন্নপূর্ণার ফুড ডেলিভারির ব্যবসাটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয়। আবার শুধুমাত্র মাতৃত্বের টানেই ভিনদেশে গিয়ে সম্পূর্ণ অপরিচিত যুবক রনিকে পুত্রস্নেহে অন্নপূর্ণার এতটা কাজে টেনে নেওয়াটাও যুক্তিতে মেনে নিতে একটু হলেও আটকে যায়। তবে আবেগের ভর করে এই খামতিগুলো বাণিজ্যিক ছবির নিজস্ব চলনে দিব্যি উতরে যায়।
আবার মা ও মেয়ের রসায়নও যে ছবিতে দারুণভাবে জমে উঠেছে তেমনটা নয়। তবে মেয়ের প্রতি অন্নপূর্ণার অপত্য স্নেহ, টান পরিচালক কিছুটা প্রচ্ছন্নভাবে রেখেছেন। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছে অন্নপূর্ণা-র মাতৃত্বের টান, আর এই চরিত্রে অনন্যা চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় মন ছুঁয়ে যায়। তিনি দক্ষ অভিনেত্রী, একথা নতুন করে বলার কিছু নেই। তবে এই ছবিতে আরও একবার নিজস্ব মুন্সিয়ানাতেই ‘অন্নপূ্র্ণা’র বেশে টুক করে কখন যে তিনি আপনাদের মনের গভীরে ঢুকে পড়বেন, তা হয়ত টেরই পাবেন না।
অভিনয়ের ক্ষেত্রে প্রশংসা অবশ্যই প্রাপ্য বিবি অর্থাৎ ওবিনয় বিশ্বাসের (কাঞ্চন মল্লিক) চরিত্রটির। মুন্নি-র ভূমিকায় অনুষ্কা বিশ্বনাথনও বেশ প্রাণোচ্ছল, চনমনে। আবার দিতিপ্রিয়াও আনন্দীর ভূমিকায় যথেষ্ঠ সাবলীল। জামাই অতনুর ভূমিকায় অর্থ মুখোপাধ্যায়ও মন্দ নয়, তবে এই চিত্রনাট্যে তাঁর বিশেষ কিছু করার ছিল না। তবে ভালো লাগে অন্নপূর্ণার স্বামীর ভূমিকায় শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়ের অভিনয়। মন্দ লাগেনি রনির ভূমিকায় ঋষভ বসু ও নিকোল-এর ভূমিকায় আলেকজান্দ্রাকেও ।