রজনী বন্দ্যোপাধ্যায়রাত ১১ টার পর পুলিশের ফোন এসেছিল। কিন্তু বিরাটি থেকে প্রগতি ময়দান থানা অনেকটাই দূরে। তাই সেদিন রাতে যেতে পারিনি। পুলিশের তরফে সকালে যতটা আগে সম্ভব, পৌঁছে যেতে বলা হয়েছিল। সেইমতো পরদিন সকাল ছ'টার মধ্যে প্রগতি ময়দান থানায় পৌঁছে গিয়েছিলাম। ইশারার মাধ্যমে নির্যাতিতা তরুণী কী বোঝাতে চাইছিলেন, কী বলতে চাইছিলেন, সেদিন কী কী হয়েছিল, তা পুলিশকে জানাই। ন'টার মধ্যে অভিযোগ দায়ের করা হয়ে যায়। তারপর আমি অফিসে চলে গিয়েছিলাম।তারইমধ্যে লালবাজারের উচ্চপদস্থ আধিকারিকরাও প্রগতি থানায় চলে আসেন। পুলিশ ডাকায় আমিও এসে যাই প্রগতি ময়দান থানায়। তরুণীর সঙ্গে আবারও কথা বলেছিলাম। প্রথমবার ক্যামেরা ছিল না। দ্বিতীয়বার ক্যামেরা রাখা হয়েছিল। সেই অভিশপ্ত রাতে কী কী হয়েছিল, তা পুরো ক্যামেরার সামনে তরুণীর থেকে জানতে চেয়েছিলাম। কোন রাস্তা দিয়ে কীভাবে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, কোথায় ফেলে দেওয়া হয়েছিল, তার খুঁটিনাটি জানতে শুরু করেছিলাম। একাধিক প্রশ্ন করতে থাকি। পুঙ্খানুপুঙ্খ জানতে চাইছিলাম। উত্তরে তরুণী যা বলছিলেন, সেটা আমি বলে দিচ্ছিলাম। সেই বয়ান লিপিবদ্ধ করা হতে থাকে।এরকম ক্ষেত্রে নির্যাতিতার সঙ্গে কথা বলা কিছুটা চ্যালেঞ্জিং। তাঁরা তো মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকেন। ফলে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। এবারের নির্যাতিত তরুণী ট্রমার মধ্যে ছিলেন। তাই তাঁর সঙ্গে একটানা কথা বলছিলাম না। মাঝেমধ্যে বিরতি দেওয়া হচ্ছিল। তরুণী যাতে মানসিক অবসাদ কাটিয়ে উঠতে পারেন, সেজন্য এক মনোবিদও ছিলেন। তাতে কিছুটা স্বচ্ছন্দ বোধ করছিলেন। ভাবছিলেন যে তাঁকে মনের কথা বোঝার জন্য দু'জন উপস্থিত আছেন। তাই কিছুটা স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে থাকেন।তবে শুধু মনোবিদ নন, নিয়ম মোতাবেক আরও একজন সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তিনিও তরুণীর থেকে বিশদে তথ্য জানতে চান। পুরো বিষয়টির 'ক্রস ভেরিফিকেশন' করা হয়। অর্থাৎ তরুণী যা বলতে চেয়েছেন, সেটা বুঝতে আমার কোনও ভুল হয়েছে কিনা, সেটা যাচাই করা হয়। যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সেই তথ্যের ভিত্তিতে পুরো মামলা এগিয়ে নিয়ে যাবে পুলিশ। যাতে কোনও ফাঁকফোকর না থাকে, তাই নিয়ম মেনেই সেই 'ক্রস ভেরিফিকেশন' প্রক্রিয়া চলে। সেই তথ্যের ভিত্তিতে মোবাইল লোকেশন, সিসিটিভি ফুটেজ সংক্রান্ত খতিয়ে দেখা হয়। পুরো বিষয়টা মিটতে বেশ কিছুটা সময় লাগে। যতটা পুলিশকে সাহায্য করা যায়, ততটা করছিলাম। শেষপর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে আমার বাড়ি ফিরতে রাত দুটো বেজে যায়। পুলিশের গাড়িতে করেই পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল।পরদিন তরুণীর মেডিকেল পরীক্ষার সময় ছিলাম। আইন অনুযায়ী, মেডিকেল পরীক্ষার সময় সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ বিশেষজ্ঞ এবং ইন্টারপ্রেটারকে থাকতে হয়। প্রথম থেকেই আমি ছিলাম। আদালতেও ওঁর সঙ্গে ছিলাম। তারইমধ্যে গত শনিবার একটি হাসপাতালে তরুণীর মেডিকেল পরীক্ষার কথা ছিল। কিন্তু চিকিৎসক যে দুপুর দুটোয় বেরিয়ে যাবেন, তা জানা ছিল না। বেলা একটা নাগাদ পুলিশ গাড়িতে করেই বাড়ি থেকে রওনা দিয়েছিলাম। যানজটের জেরে কিছুটা দেরি হয়ে গিয়েছিল। তার ফলে ২ টো ১০ মিনিট নাগাদ হাসপাতালে এসেছিলাম। তখন চিকিৎসক বেরিয়ে গিয়েছিলেন। তাই আবার সোমবার মেডিকেল হয় তরুণীর। আপাতত তরুণী যা বলতে চাইছেন, যা বোঝাতে চাইছেন, তা পুলিশ এবং আদালতের সামনে তুলে ধরছি।এক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকার প্রশংসা করতেই হয়। ২০১১ সাল থেকে আমি কাজ করছি। ধর্ষণ-সহ ১০৩ টি মামলায় কাজ করেছি। কিন্তু এবারের মতো দ্রুততা কোনও মামলায় দেখিনি। পুলিশ কোনওরকম দেরি করেনি বা টালবাহানা করেনি। প্রগতি ময়দান থানায় আমি পৌঁছানোর আগেই আকার-ইঙ্গিতের মাধ্যমে তরুণীর সঙ্গে কথা বলেছিলেন পুলিশ আধিকারিকরা। কিছু যে একটা ঘটেছে, তা তাঁরা আগেই বুঝতে পারছিলেন। পরবর্তীতে তরুণীর বাবাকে থানায় ডেকে আনা; ঘটনার সময় তরুণী যে জামা পরেছিলেন, তা নিয়ে আসা - যাবতীয় কাজই নিয়মমাফিক করেছে পুলিশ। বিশেষভাবে সক্ষম মানুষের অধিকার আইন মেনে ধাপে ধাপে এগিয়ে গিয়েছেন আধিকারিকরা।(সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত)