বুদ্ধদেব গুহ মানে অনেক স্মৃতি, অনেকখানি আবেগ। সেই স্মৃতি-আবেগ বইয়ের পাতা থেকে বেরিয়ে মনের মণিকোঠায় কখন যে জায়গা করে নেয়, তার টেরই পাওয়া বেশ মুশকিল। জীবনের ‘আয়নার সামনে’ ৮৫টি বসন্ত পার করে না ফেরার দেশে পারি দিয়েছেন, ‘ঋজুদা'র স্রষ্টা। কোভিড পরবর্তী অসুস্থতা কেড়ে নিল এই প্রবীণ বাঙালি সাহিত্যিককে। বিরাট শূন্যতা তৈরি হল বাংলা সাহিত্য জগতে।
‘মাধুকরী’র পৃথু ঘোষ চেয়েছিল, বড় বাঘের মতো বাঁচতে। আর এই গল্পের সৃষ্টিকর্তা চেয়েছিলেন সহজ ভাষার জাদুতে পাঠকের মনের গহীনে প্রবেশ করতে। ‘ঋজুদার সঙ্গে জঙ্গলে’র অভিযানেও পাঠক মনকে শামিল করতেন তিনি। তবে বুদ্ধদেব গুহ কিন্তু মোটেই শিকার বা অরণ্য কাহিনির লেখক নন। শিকার বা অরণ্যকে ছাপিয়ে গিয়েছে তাঁর লেখনি, ধরা পড়েছে একটা বিশেষ সত্ত্বা- ‘প্রেমিক’। সেই প্রেম একই সঙ্গে প্রকৃতি ও নারীর দিকে বহমান।
বিশ্ব সাহিত্যে ‘ইয়ং অ্যাডাল্ট’ ধারার প্রচলন থাকলেও বাংলা সাহিত্যে তা বিরল। এই ধরণের সাহিত্যে ধারায় পরিণত বয়স্ক পাঠকও ফিরে যায় তাঁর কৈশরে, আবার ইয়ং-দের অ্যাডাল্ট হয়ে উঠতে সাহায্য করে। বুদ্ধদেব গুহ-র লেখা বহুচর্চিত উপন্যাস ‘একটু উষ্ণতার জন্য’ বয়ঃসন্ধির এক ভাবনাকে তুলে ধরেছে। ভালবাসারা গভীরতা আর অরণ্যের গহীনতা ঘুরে ফিরে এসেছে তাঁর লেখনিতে।
বুদ্ধদেব গুহ-র লেখনি মধ্যবিত্ত জীবন থেকে বেশ খানিকটা দূরে, অরণ্যে ঘুরে বেড়ায় তাঁর গল্পের চরিত্ররা। তাঁর কাহিনির নায়ক,ঋজুদা, রুরু, পৃথু। নায়িকাদের নাম টিটি, টুঁই, কুর্চি। কিন্তু মধ্যবিত্ত বাঙালি মনকে তাঁর কলম নাড়িয়ে দিয়েছে বারবার।
বুদ্ধদেব গুহ-র অনন্য সৃষ্টি ঋজুদা। তিনি একসময় শিকারি, পরে অরণ্যপ্রেমিক। তিনি লার্জার দ্যান লাইফ এক চরিত্র, কোনওভাবেই ‘গুগুনোগুম্বারের দেশে’ বা ‘রুআহা’কে শিকারি কাহিনি বলা চলে না। বণ্যপ্রাণ ও মানুষের জীবনপঞ্জির এক অদ্ভূত সংমিশ্রণ ধরা পড়ে এই দুই উপন্যাসে। বিভূতিভূষণ পরবর্তী অরণ্য সাহিত্যকে অন্য মাত্রা দিয়েছিলেন বুদ্ধদেব গুহ, তবে একদম নিজের মতো করে।
লেখকের ‘মাধুকরী’ বা ‘চাপরাশ’-এর মতো উপন্যাসে ফুটে উঠেছে মধ্যবিত্ত বাঙালির অপরিপূর্ণ বাসনাগুলোর হাতছানি। বুদ্ধদেবের গল্পের নায়করা বরাবরই বিচ্ছিন্ন, এটাই তাঁর দর্শন। ‘মাধুকরী’-র নায়ক পৃথু ঘোষও চেয়েছিল ‘বাঘের মতো বাঁচতে’। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রকৃতির কাছে, নারীর কাছে মাধুকরীর ঝুলি নিয়ে তাঁরা দাঁড়িয়ে রয়েছে।

বুদ্ধদেবের কলমে উঠে এসেছে ‘ঋভু’-র জগতও। ‘ঋভুর শ্রাবণ’ ‘শিশুসাহিত্য’ নয়, বরং শৈশব থেকে বেরিয়ে আসার আখ্যান ছিল এটি। মনকেমন করা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছ এই সিরিজ জুড়ে। বুদ্ধদেব গুহ-র অপর চর্চিত উপন্যাস ‘বাবলি’। টিনএজ বয়সে বাড়ির বড়দের কাছে লুকিয়ে এই উপন্যাস পড়েনি এমন বাঙালি হাতেগোনা। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের কাছেও সমান আকর্ষনীয় ‘বাবলি’, তথাকথিত রূপসী নয় সে, কিন্তু তাঁকে ভালো না বেসে থাকতে পারে না পাঠক।
তবে শুধু লেখক নন, সাহিত্যের অনান্য ভাঁড়ারকেও তিনি সমৃদ্ধ করেছেন। ছবি এঁকেছেন, গান গেয়েছেন, ছড়া লিখেছেন- এক কথায় জীবদ্দশায় শিল্প-সাহিত্যের একাধিক ধারায় নিজ ছাপ রেখে গিয়েছেন বুদ্ধদেব গুহ। তবে পেশাদার জীবন তিনি শুরু করেছিলেন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসাবে। দিল্লির কেন্দ্রীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে পশ্চিমবঙ্গের আয়কর বিভাগের উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য নিযুক্ত হয়েছিলেন বুদ্ধদেব গুহ। তবে সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা আর কলমের জোরেই তিনি হয়ে উঠেছেন সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ। ঋজুদা আর ঋভুর সঙ্গে আজ তাঁদের স্রষ্টাও পারি দিয়েছেন রহস্যমাখা গন্তব্যে, হয়ত গান ধরেছেন নিজের পছন্দের। অরণ্য পেরিয়ে অজানা এক গন্তব্য, এই অভিযানের কোনও শেষ নেই।