লেখক:সরিফুল মিস্ত্রী, প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তনীতখন আমরা প্রেসিডেন্সি কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। শুনলাম কবিতার এক আলাপচারিতায় যোগদান করতে আসবেন কবি শঙ্খ ঘোষ। খবরটা শুনে প্রথমে ভাবলাম আমাদের কবিতা-প্রীতির গভীরতা মাপতে ম্যামেরা নিছকই রসিকতা করছেন। পরদিন সকালে ডিপার্টমেন্টে ঢুকতেই দেখি সাজ সাজ রব। ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে এলেন তিনি। সাংস্কৃতিক অক্ষয়ের যুগে রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দদের শেষতম প্রতিনিধি-- শঙ্খ ঘোষ। একেবারে সামনে তিন চার হাত দূরত্বে বসে কবি তখন বলে চলেছেন নিজের কবিতার কথা, আধুনিক কবিতার সম্ভাবনার কথা। ঘোরের মধ্যে আমি তখন মিলিয়ে নিচ্ছি 'কবির বর্ম' বা 'এ আমির আবরণে' লেখা তাঁর প্রত্যেকটা শব্দ। এই শব্দই ছিল কবির বর্ম তাঁর ধর্ম। সেমিনার শেষে ডিপার্টমেন্টের বারান্দায় এসে বসলেন। ধীর পায়ে একটা ডায়ারি নিয়ে তার কাছে গেলাম। কিছু লিখে দিতে হবে-- এটাই আবদার। চশমার পুরু লেন্সে জানালার বাইরে অপলক তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। "চুপ করো, শব্দহীন হও"--এর নীরব নির্দেশে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। খাতায় চোখ নামিয়ে কবি লিখলেন—"একটি কথা রইল বাকি/অন্য কোন দিনের জন্য।" এরপর বাঙালির সামাজিক রাজনৈতিক জীবনে এক বিস্তর পরিবর্তন এলো। বাম-মনস্ক বুদ্ধিজীবীর বিজ্ঞাপনী মুখ ছিলেন যে শঙ্খ ঘোষ, তিনি কেন সরকারের সমালোচনা করে পথে নামলেন বা কলম ধরলেন বলে রে রে করে উঠলেন অনেকে। কবি স্থির। ক্রান্তদর্শী কবি নিশ্চল থাকেন এসবে। আগেই লিখেছেন—"ও এমন একই সঙ্গে দু'রকম কেন?-- ওরা ভাবে" ('গুল্ম, ইথার'--শঙ্খ ঘোষ)। ওঁদের এই ভাবনা কোনদিনই নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি কবির কলমকে। আর তাই বর্তমানের দলতন্ত্রীয় স্বৈরাচারিতা নিন্দিত হয় কবির উচ্চারণে--"ভুখা মুখে ভরা গ্রাস তুলে ধরবার আগে/ প্রশ্ন করো তুমি কোন দলে।/............................... রাতে ঘুমোবার আগে ভালোবাসার আগে/ প্রশ্ন করো কোন্ দল, তুমি কোন্ দল?" ('তুমি কোন দলে'-- শঙ্খ ঘোষ) 'বাবরের প্রার্থনা'র কবির কাছে এ-উচ্চারণ অনেকের মনে হতে পারে বড্ড বেশি সরাসরি, বড্ড বেশি লাউড— শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে যায় না। কবিতার উচ্চারণ হিসেবে কথাটা কিছুটা ঠিক হয়ত কিন্তু 'কবিতা' বা 'গল্প' তো ভীষণভাবেই সমাজের প্রতিচ্ছবি, সমাজেরই ন্যারেটিভ। সে দিক দিয়ে দেখলে শঙ্খ ঘোষই যে 'যুগের বিবেক' তা মেনে নিতে সমস্যা থাকে না। আর তাই শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকিয়ে যাওয়া অঙ্গনে দাঁড়িয়ে তিনি লেখেন—"গোধূলি রঙিন মাচা, ও পাড়ায় উঠেছে আজান/ এ দাওয়ায় বসে ভাবি দুনিয়া আমার মেহমান।/ এখনও পরীক্ষা চায় আগুন-সমাজ।/এ-মাটি আমারও সেকথা সবার সামনে কীভাবে/ প্রমাণ করব আজ।" ('মাটি' শঙ্খ ঘোষ)আজকের ভারতবর্ষের জনবিরোধী নাগরিক আইন বিলের প্রতিবাদে এই কথাগুলি অজস্র মানুষের ভিতরকার কান্নাকে নিংড়ে বের করে আনে।আজ শঙ্খ ঘোষের চলে যাওয়ার দিনে মনে পড়ছে অজস্র কথা। শেষ করব এক বছর আগের একটা ঘটনা দিয়ে। ব্যক্তিগত কাজে যেতে হয়েছিল কবির সল্টলেকের আবাসনে। কবি তখন স্নানোদ্যত। বললাম একটু কথা বলে যেতাম। অগত্যা, পাঞ্জাবি গায়ে গলিয়ে এলেন নিজের লেখালিখির ঘরে। ঘরের দেওয়াল বলতে রাশি রাশি বইয়ের সেলফ। সামনের টেবিলের উল্টোপিঠে এ কালের শ্রেষ্ঠ কবি। বললেন— "একটু তাড়াতাড়ি উঠতে হবে, অন্যদিন কথা হবে।" জানতাম এমন ঘটনা ঘটতে পারে, কিন্তু কোন রকম সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইনি। ব্যাগে কলেজের সেই ডায়ারিটা নিয়ে এসেছিলাম। বার করে সেদিনের লেখাটা সামনে ধরলাম— "একটি কথা রইল বাকি/ অন্য কোন দিনের জন্য।" বললাম, "আজ সেই দিন।" স্বভাবগম্ভীর কবি মুচকি হাসেন। কয়েকটি কবিতা এবং রবীন্দ্রনাথের নাটক বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাস্য ছিল, কথা হল সে বিষয়ে। এমনিতে পড়াশোনা কম, তায় অত বড় লেখকের সামনে। ভয়ে গুটিয়ে আছি। কিছুক্ষণ কথা বললেন। শুনলাম। শুনতে শুনতে মনে পড়ছিল তাঁর লেখা কিছু কথা—"রবীন্দ্রনাথের 'রাজা' প্রত্যক্ষ বাচনেই অন্ধকারের রাজা, যে-রহস্যময় অন্ধকারের সঙ্গে 'আমাদের নিজের নিজের মতো ক'রে সম্পর্ক স্থাপন করতে হয়' আর 'সেই কঠিন অন্ধকারের অনুভব না হ'লে বাইরের পৃথিবীর এই চঞ্চল বসন্তোৎসবের মধ্যে রাজা কে চিনে নেওয়া যায় না। তাই জীবনের সেই ভীষণকে জানতেই হয়। যে-ভীষণ কঠিন, নির্দয়, নৈব্যক্তিক।" ('এই শহরের রাখাল'-- শঙ্খ ঘোষ)।এই অপ্রিয় সত্যের, হৃদয়ের বদ্ধ দ্বার উদঘাটকের নামই আমার কাছে শঙ্খ ঘোষ। যিনি বাংলা সাহিত্য এবং বাঙালি সমাজ নামক গ্রহের কাছে ছিলেন সূর্যস্বরূপ--"মাঝে মাঝে মনে হয় তুমি এ গ্রহের কেউ নও। /মেঘের ভিতরে আলো। দুহাতে সবুজ রেখা নিয়ে/ বসে আছো সানুমূলে। আমি চাই আমাকে ঘিরেই/ উঠুক তোমার ছায়াপথ। / যে-শুশ্রূষা জেগে ওঠে তোমার দু'চোখে, আমি চাই/ তার সবখানি আজ আমার শরীরে এসে বিন্দু হয়ে যাক।/ তারপরে তুমি নেই।/ তুমি আছো মাটিতে পাথরে/ ঘাসের শিহরে বৃষ্টি জলে---/ তুমি এ গ্রহের নও তবু তোমারই এ গ্রহ।"