শিখর ধাওয়ানের প্রাণখোলা হাসির আড়ালে লুকিয়ে আছে এক তীক্ষ্ণ মস্তিষ্ক। তিনি শুধু ভারতের অন্যতম সেরা হোয়াইট-বল ওপেনারই ছিলেন না, বরং একজন অসাধারণ পর্যবেক্ষণক্ষম ক্রিকেটারও। ম্যাচ পড়ে নেওয়ার ক্ষমতা যেকোনও সফল ক্রিকেটারের একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণ। ধাওয়ানের ক্ষেত্রে এটি শুধুমাত্র মাঠের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তাঁর চরিত্রের একটি স্থায়ী দিক ছিল। নিজের আত্মজীবনী “The One" বইয়ে সেই কথাই লিখলেন শিখর ধাওয়ান।
ধাওয়ান ২০১৮, ২০২১ এবং ২০২২ সালের শেষ দিকে তা নিখুঁতভাবে প্রয়োগ করেছিলেন। এই তিনটি বছর ধাওয়ানের জীবনে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, যেমন ২০১৩, ২০১৫, ২০১৭ ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। তাঁর শুরুর দিনগুলো ছিল বেশ চুপচাপ। ২০১০ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৫টি ওয়ানডেতে মাত্র ৬৯ রান, আর একটি মাত্র টি-টোয়েন্টিতে ৫ রান করেছিলেন ধাওয়ান।
তখন সেওয়াগ-গম্ভীর যুগ শেষের পথে, নতুন ওপেনার খোঁজা হচ্ছিল। ধাওয়ান তখন ঘরোয়া ক্রিকেট ও ভারত এ দলে রানের বন্যা বইয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন, সুযোগ এবার আসবেই — এবং সেই সুযোগকে তিনি ক্যাশ ইন করেন মার্চ ২০১৩-তে।
মোহালিতে অস্ট্রেলিয়ার মিচেল স্টার্ক, পিটার সিডল ও নাথান লিয়নের বিরুদ্ধে তিনি ৮৫ বলে শতরান করেন — যা আজও কোনও টেস্ট অভিষেক ম্যাচে সর্বাধিক দ্রুততম সেঞ্চুরি। ৩৩টি চার ও ২টি ছক্কা মিলিয়ে ১৮৭ রান করেন তিনি। ধাওয়ান এই বিষয় নিয়ে বলেন, ‘আমি ঘরোয়া ক্রিকেটে এসব করতাম। আমি বহু আগে থেকেই কল্পনা করতাম, আমি ভারতের হয়ে প্রচুর রান করছি, শতরান করছি, টেস্ট অভিষেকের আগেই।’
পরবর্তী ৩৩টি টেস্টে, সেই স্বপ্নের ব্যাটিং ধাওয়ান আর বারবার ফিরিয়ে আনতে পারেননি। নিউজিল্যান্ডে ১১৫, অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ৮১ (যেখানে তিনি আহত অবস্থায় আবার ব্যাট করতে নামেন), শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে তিনটি সেঞ্চুরি করেন। তিনি বলেন, ‘আমি একজন ওপেনার হিসেবে ৪০ গড়ে রান করেছি, এটা খারাপ নয়। কিন্তু ইংল্যান্ডে আমি ভালো খেলতে পারিনি। দুইবার গিয়েছিলাম, দুবারই ব্যর্থ হয়েছি। সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই করেছিলাম, কিন্তু সেটা যথেষ্ট ছিল না।’
২০১৮ সালের ইংল্যান্ড সফরই টেস্ট কেরিয়ারের ছন্দ ছিঁড়ে দেয়। তিনি বলেন, ‘ওটাই জীবন। সবকিছু সবসময় পরিকল্পনা মতো চলে না। আমি যেটুকু পেরেছি, তাতে আমি খুশি।’ ওয়ানডেতেও জায়গা হারালেন চুপিচুপি। ২০২২ সালে ধাওয়ান ওয়ানডে দল থেকে বাদ পড়েন। যদিও ওই বছর তাঁর গড় ছিল ৩৪। এটা তাঁর কেরিয়ার গড় (৪৫+) থেকে কম হলেও খুব খারাপ বলা চলে না। কিন্তু শুভমন গিল আর ইশান কিষানের উত্থান তাঁকে ছাপিয়ে যায়।
বাংলাদেশ সফরে, যা ছিল তাঁর শেষ আন্তর্জাতিক সিরিজ, সেখানে ইশান কিষান করেন ডাবল সেঞ্চুরি — যা দেখে ধাওয়ান বুঝে যান তাঁর সময় শেষ। এই বিষয়ে ধাওয়ান বলেন, ‘আমি অনেকগুলো ৫০ করছিলাম, ৭০ করছিলাম, যদিও সেঞ্চুরি করিনি। কিন্তু যেদিন ইশান কিষান ২০০ করল, তখনই ভিতর থেকে একটা আওয়াজ এল — ‘তোর কেরিয়ার শেষ হয়ে যেতে পারে।’ এবং ঠিক সেটাই ঘটল।’
তাঁর বন্ধুরা তখন তাঁর পাশে এসে দাঁড়ায়, ভাবল তিনি ভেঙে পড়বেন। কিন্তু ধাওয়ান ছিলেন শান্ত, স্বাভাবিক। তিনি এই বিষয়ে জানান, ‘ওরা এসেছিল আবেগের জোর দিতে। কিন্তু আমি একদম মুডে ছিলাম, রিল্যাক্স করছিলাম। আমি মজা করছিলাম।’ জানতে চাওয়া হয় ভারতীয় দলের কেউ কি ফোন করেছিলেন তাঁকে বাদ পড়ার পর? ধাওয়ান বলেন, ‘না, এভাবে সাধারণত হয় না। হয়তো আমি রাহুল (দ্রাবিড়) ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেছিলাম, উনি একটা মেসেজ পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু প্রত্যেকেরই নিজস্ব যাত্রা আছে। কেউ ট্যুরে ব্যস্ত, কেউ কাজে। এটা খুব স্বাভাবিক। আমরা তো অনূর্ধ্ব-১৪ থেকেই এই ওঠা-পড়ার সঙ্গে অভ্যস্ত।’
সেই মুহূর্তে তিনি নিজের আত্মজীবনী “The One" বইয়ের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বললেন, ‘এই বইটা খুব মজার। পড়লে আপনার মুখেও হাসি ফুটবে।’ ধাওয়ানকে দেখে, সেটা বিশ্বাস না করার কোনও কারণ নেই।