'দু'ঘণ্টায় কোটিপতি হয়ে যান!' আইপিএল, টি-২০ কিংবা ওয়ান ডে ম্যাচ চলাকালীন প্রায়ই টিভিতে বিজ্ঞাপনে এই লাইনগুলি শোনা যায়। যা হাতছানি দেয় গেম আসক্তদের। অনলাইন গেমিং অ্যাপের বিজ্ঞাপনগুলি এভাবেই প্রলোভন দেখায় মানুষকে। তারপর কোটিপতি হওয়ার স্বপ্নে অনলাইন জুয়ার ফাঁদে পড়ে সর্বস্ব খুইয়ে মাথা চাপড়ান। এবার এই চিত্র চিরতরে বন্ধ হতে চলেছে দেশে। বুধবারই লোকসভায় পাশ হয়ে গিয়েছে বহু প্রতীক্ষিত ‘অনলাইন গেমিং প্রচার ও নিয়ন্ত্রণ বিল, ২০২৫’।
উল্লেখ্য, এদিন ধ্বনিভোটে লোকসভায় পাশ হয়েছে অনলাইন গেমিং সংক্রান্ত এই বিল।
অনলাইন গেমিং বিল কী?
ক্যাবিনেট থেকে অনুমোদন প্রাপ্ত এই বিলটির নাম, প্রোমোশন অ্যান্ড রেগুলেশন অফ অনলাইন গেমিং বিল, ২০২৫। এর উদ্দেশ্য, অনলাইন গেমিংয়ে টাকা লেনদেন ও বিজ্ঞাপন পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা। অর্থাৎ অনলাইন গেমিংয়ে আপনি আর টাকার লেনদেন করতে পারবেন না। যদি কোনও গেমিং অ্যাপ এই নিয়ম ভাঙে তবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এমনকী জেলও হতে পারে। সবমিলিয়ে অনলাইন জুয়ার অ্যাপগুলো এই বিলের জন্য রাতারাতি ধরা পড়তে চলেছে বলেই মনে করা হচ্ছে।জানা গিয়েছে, এই বিলের মাধ্যমে যেসব অনলাইন গেমে মানুষ টাকা লাগায় সেগুলো নিষিদ্ধ করা হবে। কিন্তু এর ফলে অনলাইন সোশ্যাল গেম (যেমন- ক্যান্ডি ক্রাশ, লুডো) এবং ই-স্পোর্টসকে উৎসাহ দেওয়া হবে। এতে ভারতীয় স্টার্টআপরা নতুন করে সুযোগ পাবে এবং গেমিং ইন্ডাস্ট্রির নতুন বাজার তৈরি হবে। অর্থাৎ ঝুঁকিবিহীন গেমগুলোকেই উৎসাহ দেওয়া হবে।
বিলে প্রস্তাব করা হয়েছে, আইন কার্যকর হওয়ার পর নিয়মভঙ্গ করে অনলাইন মানি গেমিং সার্ভিস চালালে তিন বছর পর্যন্ত জেল অথবা এক কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা, কিংবা দু'টোই হতে পারে। নিয়ম ভেঙে বিজ্ঞাপন প্রচারকারীদের জন্য দু'বছর পর্যন্ত জেল অথবা ৫০ লক্ষ টাকা জরিমানা, কিংবা দু'টোই হতে পারে। একইভাবে কোনও ধরনের টাকা লেনদেনে জড়িতদেরও শাস্তি দেওয়া হবে। বারবার নিয়ম ভাঙলে পাঁচ বছর পর্যন্ত জেল ও বড় অঙ্কের জরিমানা হতে পারে।বিলে স্পষ্ট বলা আছে, অনলাইন গেম খেলছে এমন কাউকে অপরাধী বানানো হবে না। তাদের অপরাধীর তালিকায় নয়, বরং ভুক্তভোগীর তালিকায় রাখা হবে। অনলাইন জুয়া চালাচ্ছে বা তাতে উৎসাহ দিচ্ছে এমন সংস্থা বা ব্যক্তিদেরই শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।
কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে ভারতের অনলাইন গেমিং সংস্থাগুলির। উইঞ্জো, এমপিএল বা ড্রিম ১১ এই ধরনেরই সংস্থা। কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তে বিপাকে পড়তে পারে তারাও।বেশ কিছু বছর ধরে ভারতে গেমিং শিল্পকে একটি উদীয়মান ক্ষেত্র হিসাবে দেখা হচ্ছে। অনলাইন গেমে বাজি ধরার পিছনে প্রতি মাসে ভারতে গড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। তাই গত কয়েক বছরে গেমিং শিল্পে ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে বহু ছোট-বড় সংস্থা।বর্তমানে ভারতের গেমিং ইন্ডাস্ট্রির বাজার মূল্য রয়েছে ৩.৭ বিলিয়ন ডলার। ২০২৯ সালের মধ্যেই এই বাজারমূল্য হয়ে যাবে ৯.১ বিলিয়ন ডলার। ১৯.৬ শতাংশ বার্ষিক হারে বাড়বে এই সেক্টরের বাজারমূল্য। ফলে এমন আইন এলে রাতারাতি ক্ষতির মুখে পড়বে বহু সংস্থা।কাজ হারাতে পারেন দুই লক্ষ মানুষ। শুধু তা-ই নয়,২৫,০০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ ক্ষতির মুখে পড়লে তা থেকে প্রাপ্ত বার্ষিক ২০,০০০ কোটি টাকার জিএসটি আদায়ও হবে না।
নতুন বিলকে স্বাগত
এভাবে ঝুঁকিপূর্ণ জুয়া ভিত্তিক গেমকে দমন করে, শিক্ষামূলক ও দক্ষতা বাড়ানো গেমকে উৎসাহ দেওয়াই সরকারের লক্ষ্য। আইন কার্যকর হলে বিদেশি প্ল্যাটফর্মও ভারতীয় ব্যবহারকারীর জন্য অর্থভিত্তিক গেম চালাতে পারবে না।ভারতের গেমিং ইন্ডাস্ট্রি এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে। এস্৮ইউএল-র কো-ফাউন্ডার অনিমেষ ‘থাগ’ আগরওয়াল বলেন, 'এই বিল ভারতীয় ই-স্পোর্টসের জন্য ঐতিহাসিক মুহূর্ত। দক্ষতা নির্ভর প্রতিযোগিতা ও বাজি নির্ভর গেমের মধ্যে সুস্পষ্ট সীমারেখা টানা হয়েছে। এর ফলে আমাদের ইকোসিস্টেম সুরক্ষিত থাকবে এবং সংগঠিত বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি হবে।' নডউইন গেমিংয়ের ম্যানেজিং ডিরেক্টর অক্ষত রাতি জানান, 'সরকারের এই উদ্যোগ ইতিবাচক। তবে ই-স্পোর্টস, অনলাইন গেমিং, সামাজিক গেমিং ও মানি গেমিংয়ের পার্থক্য স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত হওয়া জরুরি।'
‘প্রমোশন অ্যান্ড রেগুলেশন অব অনলাইন গেমিং বিল, ২০২৫’ ভারতীয় গেমিং ইন্ডাস্ট্রির জন্য এক মোড় ঘোরানো আইন হতে চলেছে। একদিকে যেমন বাজি ও জুয়া নির্ভর গেমের উপর কড়া শাস্তি আরোপ করা হচ্ছে, তেমনি অন্যদিকে ই-স্পোর্টস ও সামাজিক গেমিংয়ের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন হচ্ছে। সরকার স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে- শিক্ষা, বিনোদন ও দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক গেমকে প্রণোদনা দেওয়া হবে, কিন্তু অর্থ ভিত্তিক গেমের কোনও স্থান থাকবে না ভারতের ডিজিটাল ইকোসিস্টেমে।