না ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছেন ঝাড়খণ্ডের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এবং ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার প্রতিষ্ঠাতা শিবু সোরেন।ভারতীয় রাজনীতিতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব শিবু সোরেন। টানা চার দশকেরও বেশি সময় নিজের দল জেএমএমকে একা হাতে নেতৃত্ব দিয়েছেন এই আদিবাসী নেতা। সাধারণ মানুষের মধ্যে বেশি জনপ্রিয় ছিলেন ‘দিশম গুরু’ বা মহান নেতা ও ‘গুরুজি’ নামে। পৃথক ঝাড়খণ্ড রাজ্য গঠনে তাঁর অবদান ছিল অপরিসীম। সোমবার শিবু সোরেনের মৃত্যুতে এক দীর্ঘ রাজনৈতিক যুগের সমাপ্তি ঘটল।
শিকড় থেকে রাজনৈতিক শিখর
শিবু সোরেন ১৯৪৪ সালের ১১ জানুয়ারি, বর্তমান ঝাড়খণ্ডের নেমরা গ্রামে এক সাঁওতাল আদিবাসী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্ম হয়েছিল রামগড় জেলায়, যা তখন বিহারের অংশ ছিল।১৯৫৭ সালের ২৭ নভেম্বর যখন তিনি স্কুলছাত্র, তখন তাঁর বাবাকে মহাজনদের ভাড়াটে গুণ্ডারা হত্যা করে বলে অভিযোগ। সেই সময় শিবু সোরেনের বয়স মাত্র ১৫। এই ঘটনা তাঁর জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। সেখান থেকেই শুরু হয় তাঁর লড়াই। তিনি সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন এবং আদিবাসী অধিকার রক্ষার দৃঢ় প্রচারক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি জমির অধিকার ও জমিদারদের শোষণের বিরুদ্ধে সরব হন।মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি ‘সাঁওতাল নবযুবক সংঘ’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন।
১৯৭২ সালে শিবু সোরেন বাঙালি বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়ন নেতা এ কে রায় এবং কুরমি মাহাতো নেতা বিনোদ বিহারী মাহাতোর সঙ্গে মিলে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা গঠন করেন। ধীরে ধীরে শিবু সোরেন ঝাড়খণ্ড রাজ্য গঠনের আন্দোলনের প্রধান মুখ হয়ে ওঠেন। বিহার থেকে আলাদা হয়ে পৃথক ঝাড়খণ্ড রাজ্য গঠনের পিছনে তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। কয়েক দশকের আন্দোলনের পর, ১৫ নভেম্বর ২০০০ সালে আলাদা রাজ্য হিসেবে ঝাড়খণ্ডের জন্ম হয়।তৃণমূল স্তর থেকে উঠে আসা এই রাজনীতিকের আদিবাসীদের উন্নয়নে উদ্যোগ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।তবে শিবু সোরেন শুধুমাত্র রাজ্য রাজনীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলেন না।
কেন্দ্রে বিশেষ ভূমিকায় শিবু সোরেন
রাজনৈতিক জীবন বর্ণময় ছিল শিবু সোরেনের।১৯৮০ সালে লোকসভার সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি। রাজসভার পদও ছিল তাঁর। ১৯৮০ সাল থেকে ২০০৫ পর্যন্ত সাতবার লোকসভা সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন শিবু সোরেন। পাশাপাশি রাজ্যসভাতেও তিনবার নির্বাচিত হন তিনি।১৯৯৮, ২০০২ এবং ২০২০ সালে রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন শিবু সোরেন।ইউপিএ সরকারের জমানায় ২০০৪ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে তিন দফায় কেন্দ্রীয় কয়লা মন্ত্রকের দায়িত্ব সামলেছেন তিনি।পরে কয়লা কেলেঙ্কারিতেও তাঁর নাম জড়িয়েছিল।
চিরুডিহ হত্যা মামলা
২০০৪ সালে মনমোহন সিং সরকারের আমলে কেন্দ্রীয় কয়লা মন্ত্রী হন শিবু সোরেন। কিন্তু বহু পুরনো চিরুডিহ হত্যা মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হওয়ায় পদত্যাগ করতে বাধ্য হন তিনি। ২০০৪ সালের জুলাই মাসে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এক মাসেরও বেশি সময় বিচার বিভাগীয় হেফাজতে থাকার পর, ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বরে শিবু সোরেন জামিনে মুক্তি পান।এরপর নভেম্বরে তাঁকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় ফের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।২০০৬ সালে এই হত্যা মামলায় তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। তবে পরে আদালতের নির্দেশে সেই রায় বাতিল হয়ে যায়।
২০০৬ সালের ২৮ নভেম্বর, শিবু সোরেনকে তাঁর প্রাক্তন ব্যক্তিগত সচিব শশীনাথ ঝা-এর অপহরণ ও খুনে জড়িত একটি মামলায় দোষী সাব্যস্ত করা হয়। দাবি করা হয় যে ঝা-কে ১৯৯৪ সালের ২২ মে দিল্লির ধৌলাকুয়াঁ এলাকা থেকে অপহরণ করা হয়েছিল এবং রাঁচির কাছে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। সিবিআই চার্জশিটে বলা হয়েছে যে, ১৯৯৩ সালের জুলাই মাসে অনাস্থা প্রস্তাবের সময় কংগ্রেসের পিভি নরসিমা রাও সরকারকে বাঁচাতে কংগ্রেস এবং জেএমএমের মধ্যে কথিত চুক্তি সম্পর্কে অনেক কিছু জানতেন ঝা। ২০০৬ সালের ২৮ নভেম্বর, সোরেনকে তাঁর প্রাক্তন ব্যক্তিগত সচিব শশীনাথ ঝা-এর অপহরণ ও খুনে জড়িত একটি মামলায় দোষী সাব্যস্ত করা হয়। দাবি করা হয় যে ঝা-কে ১৯৯৪ সালের ২২ মে দিল্লির ধৌলাকুয়াঁ এলাকা থেকে অপহরণ করা হয়েছিল এবং রাঁচির কাছে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। সিবিআই চার্জশিটে বলা হয়েছে যে, ১৯৯৩ সালের জুলাই মাসে অনাস্থা প্রস্তাবের সময় কংগ্রেসের পিভি নরসিমা রাও সরকারকে বাঁচাতে কংগ্রেস এবং জেএমএমের মধ্যে কথিত চুক্তি সম্পর্কে অনেক কিছু জানতেন ঝা। ভারত সরকারের কোনও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর খুনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার এটিই প্রথম ঘটনা। ২০০৬ সালের ৫ ডিসেম্বর শিবু সোরেনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
শিবু সোরেনকে হত্যার ষড়যন্ত্র
২৫ জুন ২০০৭ সালে শিবু সোরেনকে দুমকায় জেলে নিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর গাড়ির উপর বোমা হামলা চালানো হয়, কিন্তু কেউ আহত হয়নি। ২০০৭ সালের ২৩ অগস্ট দিল্লি হাইকোর্ট জেলা আদালতের রায় বাতিল করে শিবু সোরেনকে খালাস দেয়, এই বলে যে 'বিচার আদালতের বিশ্লেষণ বিশ্বাসযোগ্য নয় এবং টেকসই নয়।'
ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী
শিবু সোরেন প্রথমবার ২০০৫ সালে প্রথমবার ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হন। কিন্তু বিধানসভায় আস্থা ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে না পারায় মাত্র ৯ দিনের মধ্যেই তাঁকে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিতে হয়। পরে তিনি আগস্ট ২০০৮ থেকে জানুয়ারি ২০০৯ এবং ডিসেম্বর ২০০৯ থেকে মে ২০১০ পর্যন্ত। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে তিনি একবারও পূর্ণ মেয়াদে (পাঁচ বছর) মুখ্যমন্ত্রীর পদে থাকতে পারেননি।১৯৮৭ সালে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা-এর সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত তিনি টানা ওই পদে বহাল ছিলেন। প্রায় চার দশক ধরে তিনি ছিলেন দলের প্রধান চালিকাশক্তি ও আদিবাসী রাজনীতির মুখ।
রাজনৈতিক পরিবার
শিবু সোরেনের ব্যক্তিগত জীবন তাঁর রাজনৈতিক কেরিয়ারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।শিবু সোরেন রূপী কিস্কুর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর তিন ছেলে দুর্গা সোরেন, হেমন্ত সোরেন এবং বসন্ত সোরেন এবং এক মেয়ে অঞ্জলি সোরেন। তাঁর বড় ছেলে দুর্গা ১৯৯৫ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বিধায়ক ছিলেন। দুর্গার মৃত্যুর পর স্ত্রীও বিধায়ক হন কিন্তু তিনি এখন বিজেপি যোগ দিয়েছেন। বসন্ত সোরেন ঝাড়খণ্ড যুব মোর্চার সভাপতি, এবং দুমকার বর্তমান বিধায়ক। অন্যদিকে, হেমন্ত সোরেন ঝাড়খণ্ডের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী।তাঁর পুত্রবধূ এবং হেমন্ত সোরেনের স্ত্রী কল্পনা সোরেনও একজন বিধায়ক।