গত সপ্তাহে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে বিবেক অগ্নিহোত্রীর সিনেমা দ্য বেঙ্গল ফাইলস ছবিটি। যদিও বাংলায় অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ এই ছবি। কোনো হলেই জায়গা মেলেনি। এমনকী, পরিচালক বিবেকের উপর অভিযোগ বাংলার ইতিহাস বিকৃত করার। এক বিশেষ রাজনৈতিক দল (আপনি পদ্মফুলও পড়তে পারেন)-এর জন্য বাংলার ভোটের আগে এই ‘প্রোপাগন্ডা সিনেমা’টি বানানো বলেও মত নিন্দুকদের।
এবার ছবি দেখে নিজের মতামত ভাগ করে নিলেন দিল্লি নিবাসী তসলিমা নাসরিন। বাংলাদেশী লেখিকা লেখেন, ‘দীর্ঘ সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে দ্য বেঙ্গল ফাইলস দেখতে দেখতে ভাবছিলাম বাংলায় কি সিনেমা বানানোর লোক কম ছিল, কেন উত্তর প্রদেশের লোকদের বাংলার কাহিনী নিয়ে হিন্দি ভাষায় সিনেমা বানাতে হয়? কেন বাঙালিরা বাংলার ইতিহাস নিয়ে সিনেমা বানাতে আগ্রহী নন? আগ্রহী না হলে তারপর তো বহিরাগত কেউ এসে বানিয়ে ফেলে সিনেমা। বহিরাগত যদি ইতিহাস সঠিক ভাবে উপস্থাপন না করেন, তখন বেঠিক ইতিহাসই আমজনতার কাছে কিন্তু ‘ঠিক ইতিহাস’ হয়ে দাঁড়ায়।’
নিজের অনুরাগী ও পাঠকদের জন্য ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশান ডে’-র একটা আভাসও দেন তিনি। সঙ্গে প্রশ্ন তোলেন কেন এত বড় একটা ঘটনা নিয়ে এতদিন কোনো কাজ হয়নি। সিনেমা তো দূর, একটা ডকুফিল্মও কেন নেই? লেখেন, ‘মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান নামের একটি আলাদা রাষ্ট্রের দাবিতে অল ইণ্ডিয়া মুসলিম লীগ থেকে ডাইরেক্ট অ্যাকশানের, অর্থাৎ দেশ জুড়ে হরতাল পালন করার , গাড়ির চাকা ঘুরবে না, দোকান পাট খুলবে না'র ডাক দেওয়া হয়েছিল। ডাইরেক্ট অ্যাকশানের দিন, ১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্ট তারিখে, কলকাতায় হিন্দু-মুসলমানে দাঙ্গা বেঁধে যায় । সেই দাঙ্গাকেই বলা হয় ‘দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’। কেন সেই ভয়াবহ দিনটি নিয়ে, কেন নোয়াখালির দাঙ্গা নিয়ে, বাংলায় কোনও সিনেমা হয়নি আজও? দাঙ্গার ইতিহাসের নথিপত্রের কি অভাব ছিল বাংলায়? অথেন্টিক তথ্য সম্বলিত ডকুফিল্ম বা ফিচার ফিল্ম বানানোই তো যেত।’
তবে তসলিমার কথা থেকেই স্পষ্ট যে, তাঁর খুব একটা ভালো লাগেনি বেঙ্গল ফাইলস। কারণ তাঁর ফেসবুক পোস্টের একাংশে লেখা, ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস মনে হয় না কারও হৃদয় স্পর্শ করার জন্য বানানো হয়েছে। যাঁরা ভালো সিনেমা দেখে অভ্যস্ত, তাঁরা এই সিনেমা দেখেই বুঝবেন, এটি সিনেমা হিসেবে ভাল নয়। চরিত্রগুলো বিশ্বাসযোগ্য নয়। এই সিনেমা কিছু ট্র্যাজিক ঘটনাকে স্মরণ করার জন্য বানানো হয়েছে নাকি কোনও বদ উদ্দেশ্য নিয়ে বানানো হয়েছে, সেটা সিনেমার দর্শকরা বুঝে নেবেন। তথ্য যা দেওয়া হয়েছে, তা সত্য না মিথ্যে, তাও গবেষকরা বলবেন। আজ দ্য হিন্দু পত্রিকায় রিভিউ বের হয়েছে, লিখেছে এই সিনেমা মানুষের মনে সাম্প্রদায়িক বিষ ঢোকাচ্ছে। হ্যাঁ, সাম্প্রদায়িক বিষ ঢোকাচ্ছে, কিন্তু তারপরও আমি মনে করি বাংলার দাঙ্গা নিয়ে পরিচালক তাঁর মত প্রকাশ করেছেন। গান্ধীবিরোধী, নেহরুবিরোধী, সেক্যুলারিজমবিরোধী, মুসলিমবিরোধী মত প্রকাশের অধিকার তাঁর আছে। এখন অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ, উদার, মুক্তচিন্তক কেউ বানান নির্ভেজাল কোনও সিনেমা। সেও আমরা দেখব।’
এরপর নিজের দেশের প্রসঙ্গ টেনে তসলিমা লিখেছেন, ‘আমার মনে হয় বাংলাদেশে যে হিন্দুর ওপর অত্যচার হয়, হিন্দুরা যে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়, এ নিয়ে সচেতন এবং সংবেদনশীল বাঙালি পরিচালকদের সিনেমা বানানো উচিত। আমার লজ্জা উপন্যাস নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের কেউ সিনেমা বানাতে সাহস করেননি। ভেবেছেন এতে তাঁদের সেক্যুলার পরিচয় ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। বাংলাদেশের হিন্দুদের ইতিহাস নিয়ে ভালো কোনও পরিচালক ভালো সিনেমা বানান। তা না হলে কোনও উটকো লোক, দ্য বাংলাদেশ ফাইলস নামের কোনও প্রোপাগাণ্ডা ফিল্ম যে বানিয়ে ফেলবে না তা বলা যায় না।’