- দেবক বন্দ্যোপাধ্যায়
সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক
কালিকা বঙ্গদেশে চ অযোধ্যায়াং মহেশ্বরী।
আদ্যাস্তবের এই শ্লোকটি আমাদের জানা। মা মহামায়া কালী রূপে বঙ্গদেশে অধিষ্ঠিত। কালী কলকাত্তাওয়ালি! খোদ কলকাতাতেই কালীঘাট মন্দির, ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি, ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি এমন আরও অনেক কালীবাড়ি রয়েছে। জেলায় জেলায় ছড়িয়ে রয়েছে ডাকাতে কালী মন্দির, রঘু ডাকাতের কালী, নাচিন্দা কালী, হংসেশ্বরী কালী মন্দির, শকুন্তলা কালী, কঙ্কালীতলা কালী, দেবী চৌধুরানির কালী... দীর্ঘ নামের তালিকা। এইসবের সঙ্গে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের লীলাক্ষেত্র দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী কালী মন্দির তো রয়েছেই। দীঘার জগন্নাথের কথা বলতে গিয়ে কালী প্রসঙ্গে এতগুলো শব্দ খরচ কেন? কালী বাংলার সিগনেচার দেবী। সেই বাংলায় জগন্নাথদেবকে আনলেন কেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? জগন্নাথ কি তাঁর ব্যক্তিগত পছন্দ? আর পাঁচটা বাঙালি ও আর পাঁচটা হিন্দুর মতো জগন্নাথ তাঁর পছন্দের দেবতা হতেই পারেন কিন্তু তিনি তো কালীভক্ত। বাড়িতে শ্যামা পুজো করেন। তাহলে কি পুরীতে অসংখ্য বাঙালি সারা বছর ভিড় জমায় বলেই তাঁর এই উদ্যোগ? এমনটা ভাবা অতি সরলীকরণ হয়ে যাবে। তাহলে কেন? এই প্রশ্ন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সম্ভবত কেউ করেননি। উনিও প্রকাশ্যে কিছু বলেননি। কী ভেবে তিনি বাংলায় জগন্নাথের চর্চায় আগ্রহী হলেন?
তাহলে আসল কথায় আসা যাক। জগন্নাথ হলেন সেই দেবতা যাঁর উল্লেখ বেদে নেই। পরবর্তীতে রামায়ণ ও মহাভারতেও নেই। হিন্দু ভাবধারা অনুযায়ী ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর বা সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়ের ধারণা আছে কিন্তু কোথায় জগন্নাথ? সে কথায় আসছি। তার আগে বলি বাংলার সাধনরীতি প্রধানত শাক্ত ও বৈষ্ণব। কালী ও কৃষ্ণ। এর সঙ্গে অবশ্যই আছেন আদিবাসীদের মারাংবুরু, করম প্রমূখ। উত্তরবঙ্গের পাহাড়ি গোর্খা, নেপালি ও অন্যান্যরা সাধারণ ভাবে হিন্দু। কেউ কেউ আবার মা তারার পুজারী। এ হেন বঙ্গে জগন্নাথ চর্চার বড় উদ্যোগ ও ভাবনা খুব সহজ বিষয় নয়। গভীর চিন্তা ভাবনার উপাদান আছে মুখ্যমন্ত্রীর এই কর্মকাণ্ডে।
প্রথমত, পুরীর জগন্নাথের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছেন মা বিমলা। বিমলা হলেন আদি পরাশক্তির স্বরূপ। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে অধিষ্ঠিত। শাক্তরা মনে করেন জগন্নাথ ও বলভদ্র তাঁর ভৈরব। ভৈরব অর্থে শিব। জগন্নাথ হলেন শিব। ‘উৎকলে নাভিদেশস্ত বিরজা ক্ষেত্র মুচ্যতে । বিমলা সা দেবী জগন্নাথ স্তু ভৈরবঃ ।।’ এই পর্যন্ত পড়ে বোঝা যাচ্ছে যে বাংলার শাক্ত দর্শন কীভাবে জড়িয়ে রয়েছে জগন্নাথের সঙ্গে।
দ্বিতীয়ত, আদিবাসীদের ধর্ম বিশ্বাস। সরাসরি মারাংবুরু না হলেও শবরদের জগনাদ আদিবাসীদের দেবতা। আরাধ্য ভগবান। শবরদের জগনাদ হলেন সকলের জগন্নাথ, এই ধারণা অনেক বিশেষজ্ঞের আছে। পশ্চিমবঙ্গের আদিবাসীদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও আবেগ এইভাবেই জগন্নাথের সঙ্গে মিলে যায়।
তৃতীয়তঃ, বৈষ্ণব বিশ্বাস। শ্রীচৈতন্যের চোখে জগন্নাথ ছিলেন কৃষ্ণ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা শ্রীচৈতন্য ওই কালো রূপে বিভোর হয়ে মন্দিরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতেন। তাছাড়া একটা প্রচলিত কাহিনি আছে। যেখানে বলা হয়েছে, শ্রীকৃষ্ণের দেহ মুক্তির পর সেই দেহ নদীতে ভাসতে ভাসতে যুগের পর যুগ কাটিয়ে একদিন কাঠে পরিণত হয়। সেই কাঠ ভেসে আসে পুরীর সৈকতে। এইভাবে জগন্নাথের ধারণার মধ্যে মিশে রয়েছে বাংলার বৈষ্ণব বিশ্বাস।
চতুর্থত, জগন্নাথের সার্বিক ধারণার মধ্যে বাংলার ঘরের মেয়ে দুর্গাও জড়িয়ে। পুরীর মন্দিরে আশ্বিন মাসে ১৫ দিন ধরে বিমলাকে দুর্গা রূপে পুজো করা হয়। এছাড়া, জগন্নাথকে বামন অবতার ও নৃসিংহ অবতার রূপে পুজো করার রীতিও আছে।
এর চেয়েও বড় কথা একমাত্র জগন্নাথ যিনি ব্রাহ্মণ ও অব্রাহ্মণ উভয়ের দ্বারাই পুজিত হন। অব্রাহ্মণ দ্বৈতাপতিরাও জগন্নাথের পুজো করেন। বিশ্বাস অনুযায়ী ওঁরাই হলেন শবররাজ বিশ্ববসুর বংশধর। এই প্রথা মনু সংহিতার প্রতিস্পর্ধী। ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে স্পষ্ট প্রতিবাদ। যা আধুনিক ও বৈপ্লবিক। এইরকম একটা সময় যখন বহুত্ববাদকে ধ্বংস করতে উঠে পড়ে লেগেছে কোনও কোনও শক্তি, তখন জগন্নাথ চর্চা কেন্দ্র ও তৎসংলগ্ন মন্দির একটি প্রতীক। আধ্যাত্মিক সকল ভাব জগন্নাথের মধ্যে সমাহিত। মমতার এই বৌদ্ধিক প্রতিষ্ঠানে হিন্দুধর্মের রিয়েল স্পিরিটের অবস্থান অনুভূত হয়। দলীয় রাজনীতির ফিতে দিয়ে এই প্রচেষ্টা না মাপলেই ভালো।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত
(দেবক বন্দ্যোপাধ্যায় ২৯ বছর সাংবাদিকতা করছেন। টাইমস অফ ইন্ডিয়া’য় পেশাগত হাতেখড়ি, তার পরে ‘নিউজ টাইম’, ‘লুক ইস্ট’, ‘নর্থ ইস্ট টেলিভিশন’-সহ আরও বেশ কিছু সংবাদমাধ্যমে দীর্ঘ দিন কাজ করেছেন তিনি। বেশ কিছু সময় সামলেছেন সম্পাদকের দায়িত্বও। বর্তমানে সাংবাদিকতার পাশাপাশি কয়েকটি বেসরকারি সংবাদ মাধ্যমে রাজনীতির বিশ্লেষক।)