নরেন্দ্র মোদী সরকারের ঘোষণায় ২০২১ সাল থেকে ১৪ আগস্ট পালিত হয় ‘বিভাজন বিভীষিকা স্মৃতি দিবস।' উদ্দেশ্য একটাই- স্বাধীনতার সঙ্গে যুক্ত সেই কালো অধ্যায়টিকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া, যখন দেশভাগের আগুনে লক্ষ লক্ষ মানুষ শেকড়হীন, বাস্তুচ্যুত ও নিঃস্ব হয়েছিল। সেই উপলক্ষে প্রকাশিত বিশেষ ‘মডিউলে’ দেশভাগের ইতিহাস বিকৃত করার অভিযোগ উঠছে এনসিইআরটি-র বিরুদ্ধে।
এর আগেও এনসিইআরটি-র বিরুদ্ধে একাধিকবার স্কুলের পাঠ্যবইয়ে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ উঠেছে। এবার ষষ্ঠ থেকে অষ্টম এবং নবম থেকে দশম শ্রেণির পড়ুয়াদের জন্য প্রকাশিত বিশেষ ‘মডিউলে’ ভুল ইতিহাস পড়ানোর অভিযোগে শোরগোল পড়ে গিয়েছে গোটা দেশে।এই মডিউলে ছাত্রছাত্রীদের জানানো হবে, কীভাবে ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তানের বিভাজন সাধারণ মানুষের জীবনে অমানবিক দুর্ভোগ নামিয়ে এনেছিল এবং সেই অভিজ্ঞতা থেকে গণতান্ত্রিক সমাজকে কী শিক্ষা নিতে হবে। যে মডিউলটিকে ঘিরে বিতর্ক, সেটি ১৪ অগাস্ট ‘দেশভাগের ভয়বহতা স্মরণ দিবসে’ প্রকাশিত হয়, যাতে দিনটির গুরুত্ব বোঝানো যায় পড়ুয়াদের, পাঠ্যবইয়ের বাইরে সেই নিয়ে আলোচনা হয়, তর্ক-বিতর্ক হয় এবং প্রজেক্টে যুক্ত করা যায় সকলকে। ইংরেজি এবং হিন্দি, দুই ভাষাতেই প্রকাশ করা হয়েছে বিতর্কিত ‘মডিউলটি।'
এনসিইআরটি-র মডিউল
এনসিইআরটি-র এই বিশেষ ‘মডিউল’টির যে অংশটি নিয়ে বিতর্ক, তার নাম ‘দেশভাগের অপরাধী’। ওই অংশ বলা হয়েছে, ‘দেশভাগ কারও একার দ্বারা সম্পন্ন হয়নি। বরং তিনটি সম্মিলিত শক্তির দ্বারা সম্পন্ন হয়। মহম্মদ আলি জিন্না দেশভাগের ভাষ্য তৈরি করেছিলেন; কংগ্রেস দেশভাগ মেনে নিয়েছিল; এবং মাউন্টব্যাটেনকে দেশভাগ রূপায়িত করতে পাঠানো হয়েছিল।' মডিউলের দাবি, ব্রিটিশ সরকার স্বাধীন ভারতের পক্ষে ছিল, তবে বিভক্ত ভারতের নয়। তাদের পরিকল্পনা ছিল, ভারতকে ‘ডোমিনিয়ন মর্যাদা’ দেওয়া- অর্থাৎ নামমাত্র রাজা থাকবেন ব্রিটিশ, কিন্তু প্রশাসন চলবে ভারতীয়দের হাতে। প্রদেশগুলিকে দেওয়া হয়েছিল ডোমিনিয়নের সঙ্গে যুক্ত বা বিচ্ছিন্ন থাকার বিকল্প। কিন্তু কংগ্রেস সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।দেশের বড় নেতাদের মধ্যেও দেশভাগ নিয়ে ছিল বিভাজিত মতামত। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল প্রথমে দেশভাগের বিরোধী ছিলেন, কিন্তু পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতির চাপে একে ‘কঠিন ওষুধের মতো’ গ্রহণ করেন।
দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর একটি উক্তিও তুলে ধরে হয়েছে। ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে নেহরুর বক্তব্যের অংশ তুলে ধরা হয়েছে, যাতে বলা হয়, ‘আমরা এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছি, যেখানে হয় বিভাজন মেনে নিতে হবে, অথবা সংঘাত এবং বিশৃঙ্খলা চলতেই থাকবে। দেশভাগ খারাপ। কিন্তু ঐক্যের চেয়েও গৃহযুদ্ধের মূল্য আরও বেশি হবে।' ১৯৪০ সালের লাহৌর চুক্তির উল্লেখ করে লেখা হয়েছে, ‘মহম্মদ আলি জিন্নাহ বলেছিলেন হিন্দু ও মুসলিমরা, দুই পৃথক গ্রামের বাসিন্দা, তাঁদের দর্শন, সামাজিক রীতিনীতি, সাহিত্য সব আলাদা।' অন্যদিকে লর্ড মাউন্টব্যাটেন বলেন, 'আমি ভারত ভাগ করিনি, ভারতীয় নেতারাই অনুমোদন করেছিলেন। আমি শুধু বাস্তবায়ন করেছি।' মহাত্মা গান্ধী দেশভাগের বিরোধী ছিলেন। ১৯৪৭ সালের জুন মাসে তিনি বলেন, 'কংগ্রেস দেশভাগ মেনে নিলে তা আমার পরামর্শের বিরুদ্ধে হবে। তবে আমি হিংসার সঙ্গে এর বিরোধিতা করব না।' অবশেষে নেহরু ও প্যাটেল গৃহযুদ্ধের ভয় থেকে দেশভাগে সম্মতি দেন। গান্ধীজিও আর প্রতিবাদে অনড় থাকেননি। ১৪ জুন কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সভায় তিনি অন্য নেতাদেরও দেশভাগে রাজি করান।
দেশভাগের 'দীর্ঘমেয়াদি ক্ষয়ক্ষতি' বর্ণনা করতে গিয়ে এনসিইআরটি দাবি করেছে, আজও বাইরের শত্রুর আঘাত সহ্য করতে হচ্ছে ভারতকে, সেই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ সাম্প্রদায়িক বিভাজন বয়ে চলেছে ভারত। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে আজও শত্রুতা, সন্দেহের পরিবেশ রয়েছে, যার দরুণ দেশভাগ হয়েছিল। শুধু তাই নয়, এনসিইআরটি দেশভাগকে সরাসরি কাশ্মীর সঙ্কটের জন্য দায়ী করেছে। সেই সঙ্গে দেশভাগের জন্যই বিদেশি শক্তিরা পাকিস্তানকে সমর্থন করছে এবং ভারতের উপর চাপ বাড়াচ্ছে, যার দরুণ ভারতকে সামরিক ক্ষয়ক্ষতি বহন করতে হচ্ছে এবং বিদেশনীতিতেও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব রয়ে যাচ্ছে বলে দাবি তাদের।
সরব কংগ্রেস
বিশেষ ‘মডিউলটি’ সামনে আসতেই এনসিইআরটি-র বিরুদ্ধে সরব হয়েছে কংগ্রেস। সাংবাদিক বৈঠকে দলের মুখপাত্র পবন খেরা বলেন, 'এই তথ্য পুড়িয়ে ফেলা উচিত। কারণ এটা সম্পূর্ণ অসত্য। হিন্দু মহাসভা এবং মুসলিম লিগের আঁতাতের জন্যই দেশভাগ হয়েছে। আরএসএস দেশের জন্য বিপজ্জনক। ১৯৩৮ সালে হিন্দু মহাসভাই প্রথম দেশভাগের ভাষ্য তৈরি করে। ১৯৪০ সালে সেটির পুনরাবৃত্তি ঘটান জিন্না।' এই গোটা বিতর্কে আবারও এনসিইআরটি-র ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। পড়ুয়াদের ভুল ইতিহাস পড়িয়ে এনসিইআরটি-র মাধ্যমে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছে বিরোধীদের।