অবশেষে প্রতীক্ষার অবসান। বাংলা সারেগামাপা-২০২৪-এ যুগ্মভাবে বিজয়ী হয়েছেন দেয়াশিনী রায় ও অতনু মিশ্র। ২ মার্চ সম্প্রচারিত হয়েছে এই রিয়েলিটি শোয়ের গ্র্যান্ড ফিনালে। আপাতত তাই জয়ের আনন্দে আত্মহারা দুই বিজেতা। তবে কেমন ছিল এই পুরো যাত্রাপথ? অনুভূতিটা ঠিক কেমন? সেই সবকিছু Hindustan Times Bangla-র সঙ্গে ভাগ করে নিলেন SaReGaMaPa জয়ী গায়িকা দেয়াশিনী। অকপটে জানালেন আরও নানান কথা…।
SaReGaMaPa ২০২৪-এর বিজেতা হওয়ার জন্য অনেক শুভেচ্ছা? এখন ঠিক কী মনে হচ্ছে?
দেয়াশিনী: দারুণ আনন্দে আছি। (হাসি) তবে ঠিক যখন আমার নাম ঘোষণা হল, সেই মুহূর্তে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না যে কী করব! ঠিক কী হচ্ছে? পুরো ব্ল্যাঙ্ক হয়ে গিয়েছিলাম।
আর যদি শুরুর দিনে ফিরে যাই, তাহলে যখন প্রথম অডিশন দিয়েছিলাম, তখন ফার্স্ট অডিশনেই হোল্ডে চলে যাই। তখন তো আশাও করিনি যে এই জায়গায় যাব! বা এমন একটা দিনও আসতে পারে। তখন শুধু ভেবেছি, কীভাবে আরেকটু ভালো করে পরের পর্বে যাব। সেই সময় লড়াইটা অনেকটাই ছিল। আর যখন বিজেতা হিসাবে আমার নাম ঘোষণা হল, তখন সকল বিচারকরাই মঞ্চে এসেছিলেন। আইডি স্যার (ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত) আমায় বলেছিলেন, ‘দেয়াশিনী, সেই হোল্ডিং জোনে যাওয়া থেকে বিজেতা হওয়া, এটা যদি মনে রাখতে পারো, তাহলেই নিজের একদিন লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে। এই জার্নিনা মাথায় রাখার চেষ্টা কোরো’। আর আমিও অবশ্যই এটা মাথায় রেখে চলার চেষ্টা করব।
বাড়ির লোকজন কী বলছেন?
দেয়াশিনী: মা-বাবা সকলেই ভীষণ খুশি, বাকি সকলেও। একটা কথা বলতে চাই, ২০১২-১৩ সালে আমি বাবা-মায়ের সঙ্গে সারেগামাপা-র গ্র্যান্ড ফিনালে দেখতে এসেছিলাম। তখন আমি গানও সিরিয়াসলি শিখতামও না। সেসময় আমি ৮-৯ বছরের কিশোরী, র্শকদেন সিটে বসে কখনও ভাবিও নি যে এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে আমিও কোনওদিন গাইব! আর এবার যখন ফাইনালে সারেগামাপা-র মঞ্চে আমার প্রথম এন্ট্রি হল, শুধু আমার একটাই কথা মনে হচ্ছিল যে, শুধুমাত্র আমার জন্য গোটা মদনপুরবাসী, এই সারেগামাপা-র গ্র্যান্ড ফিনালে দেখছেন।
সারেগামাপা-ই কি জীবনের প্রথম রিয়েলিটি শো?
দেয়াশিনী: হ্যাঁ, সারেগামাপা-ই আমার জীবনের প্রথম রিয়েলিটি শো। ২০১২-১৩ সালে যেবার বাবা-মায়ের সঙ্গে গ্র্যান্ড ফিনালে দেখতে গিয়েছিলাম, তার ঠিক পরের বছরই ছোটদের যে অডিশন হয়েছিল সেখানে এসেছিলাম। সেসময় ভাবিওনি যে সুযোগ পাব!, এত সিরিয়াসও ছিলাম না। প্রথম রাউন্ডেই বাদ পড়ি। তবে সেই সারেগামাপা- আামার জীবনে বিশেষ ভূমিকা রাখে, কারণ, তখন এক প্রতিযোগীর মায়ের কাছে ললিত-কলার (বর্তমানে আমি যেখানে গান শিখি) নম্বর পেয়েছিলাম। তাই ওটা আমার জীবনের একটা টার্নিং পয়েন্ট বলতে পারি।
তারপর ললিত-কলাতে গান শেখা শুরু করলেন?
দেয়াশিনী: তারপরই ঠিক নয়। ওই অডিশন থেকে ফেরার পর আমি একদিন খেলতে গেছি, একজন বললেন, ‘কীরে তুই গান বাজনা ছেড়ে দিয়েছিস নাকি?’ সেদিন ওই কথাটা খুব গায়ে লেগেছিল। আমি মা-কে এসে বললাম, গান শিখব। মদনপুর থেকে বাঘাযতীন অনেক দূরত্ব। ৩ ঘণ্টা যাওয়া-৩ ঘণ্টা আসা। তারপর ২ ঘণ্টা গান শেখা। তাই সারাদিনই চলে যেত। আবার খরচ সাপেক্ষও ছিল। তবে মা রাজি হলেন। তবে মা আমাকে প্রথম দিন থেকেই বলে দিয়েছিলেন ‘যদি একদিন দেখি, তুমি ঠিক করে রেওয়াজে বসো নি, বা ফাঁকি মেরেছো, বা টাস্ক দিতে পারোনি। তাহলে কিন্তু পরের সপ্তাহ থেকেই ক্লাস বন্ধ।’ মায়ের চাপেই তখন নিয়মিত রেওয়াজ করতাম।
মা ছোট ছোট টার্গেট দিত। যেমন ক্লাসের মধ্যে সেরা হতে হবে। তারপর বলল, জোজো দাদার (সীমান্ত সরকার) চোখে পড়তে হবে, এভাবেই…। আর ছোট থেকেই আমি মায়ের কথা মেনে চলতাম। ১-দেড় বছর এভাবেই চলল। তারপর নিজের থেকেই গানের প্রতি ভালোবাসা চলে এসেছিল।
মা-বাবাও কি গানের জগতের মানুষ?
দেয়াশিনী: আমার পুরো পরিবারই আসলে মিউজিক্যাল। আমার মাও গান শিখতেন বিয়ের আগে, তবে সেটা চালিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি। আর সেই ইচ্ছেটা মেয়ের উপর দিয়ে পূরণ করতে চেয়েছিলেন। আর আমার বাবাও পেশাদার মিউজিশিয়ানস। আর আমার প্রথম গান শেখা হল আমার দাদুর বোনের কাছে। আমি ওঁকে গানদিদি বলতাম। আমার দাদুও তবলা বাজাতেন। আমার দুই মামাও তবলা বাজান। এই আর কী…। (হাসি)
প্রথম গান শেখা কবে শুরু?
দেয়াশিনী: ৫ বছর বয়সে। তখন খুবই ছোট। শিখে এসে হয়ত ভুলেও যেতাম। সিরিয়াস ছিলাম না। ঠিক করে গান শিখি, ১০ বছর বয়সে এসে ললিত কলায়।
ললিত কলায় শেখা শুরু পর আর কোনও গানের শোয়ে গিয়েছিলেন?
দেয়াশিনী: গান শেখা শুরুর পর হিন্দি রিয়েলিটি শো ‘লাভ মি ইন্ডিয়া কিডস’ যাই। তবে সেখানে কিছুই করতে পারিনি। সেমিফাইনালেই বাদ পড়ি। এসে মন খারাপ ছিল। তারপর যাই সুপার সিঙ্গারে যাই। ওখানে ফাইনালে উঠেছিলাম ঠিকই, তবে কোনও পজিশন যাইনি।
এরপর বাড়ি ফিরে এলে প্রতিবেশীদের অনেকেই বলেন, ‘কী হেরে ফিরে গেলে আরেকটু আশা করেছিলাম’। ওই কথাটা খুব আঘাত করেছিল। হয়ত উনি আশা করেছিলেন বলেই বলেছিলেন। তারপর পরিশ্রম শুরু করি। রোজ ৪-৫ ঘণ্টা রেওয়াজে বসতাম। ২ বছর পর গত বছর মার্চে সারেগামাপা-তে অডিশন দিই। যদিও শুরুটা নড়বড়েই ছিল। ঠিক কী কারণে হচ্ছিল বুঝতে পারছিলাম না। কারণ, রিহার্সালে ঠিক গাইলাম, স্টেজে গিয়ে ঠিকমত গাইতে পারছিলাম না। নিজের সেরা দিতে পারছিলাম না। এভাবে ৪টি পর্ব কাটে। সেসময় আমার গ্রুমার্সরা খুব সাহায্য করেছিলেন। বিশেষ করে রথিজিৎ স্যার। উনি বারবার বলেছিলেন, ‘দেয়াশিনী তুই পারবি, তুই ভেঙে পড়বি না। একদিন আসবে তুই যেদিন নিজের সেরাটা দিবি। তারপর আর ফিরে তাকাতে হবে না।’
গ্রুমার্সদের কাছে তাহলে অনেকটা সাপোর্ট পেয়েছেন?
দেয়াশিনী: হ্য়াঁ, গ্রুমার্সরা খুবখেটেছেন। আমার ছোট ছোট লাইন শিখিয়েছেন। বিচারকরাও অফ ক্য়ামেরা আমার ছোট ছোট ভুল ধরিয়ে দিতেন। যে জায়গাটা খামতি বলতেন। আর তাই হয়ত আজ আমি এখানে। তবে আমার মনে হয়, ওই প্রথম ধাক্কাটা না খেলে হয়ত আমি এই জায়গায় আসতে পারতাম না।
সারেগামাপা-তে থাকার সময় কোথায় প্রতিযোগীরা কোথায় থাকতেন?
দেয়াশিনী: আমরা শ্রাচি গ্রীনউড এলিমেন্টে থাকতাম। আর রিহার্সাল হত রাজারহাটের DRR- স্টুডিওতে।
এরপর কীভাবে এগোতে চান?
দেয়াশিনী: গান নিয়েই থাকতে চাই। শিখতে চাই আরো। আমার কিছু অরিজিনালস বের করকে চাইব, সেগুলি মানুষ শুনুক। তবে এখনও পর্যন্ত গান লেখা, সুর করা এসব কিছু করিনি। তবে করার ইচ্ছে রয়েছে। বেশকিছু ইনস্ট্রুমেন্ট (বাজনা) শেখারও ইচ্ছে আছে। আর আপাতত রেকর্ডিং, শো, এইসব নিয়েই থাকতে চাই।
প্লে ব্যাকের প্রস্তাব পেয়েছেন?
দেয়াশিনী: না এখনও পাইনি, দেখা যাক।
আর এখন তো আপনি ছাত্রী? কী নিয়ে পড়ছেন?
দেয়াশিনী: জার্নালিজম ও মাসকমিউনিকেশন নিয়ে পড়ছি মহারাজা মনীন্দ্রচন্দ্র কলেজ থেকে। পড়াশোনা চালিয়ে যাব। মাস্টার্স করার ইচ্ছে আছে। আর এছাড়া গান তো আছেই। ওটাতেই কেরিয়ার গড়তে চাই।
স্কুলিং কোথায়?
দেয়াশিনী: মদনপুর আনন্দমার্গ প্রাইমারি স্কুলে পড়তাম ক্লাস ফোর পর্যন্ত। পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত মদনপুর কেএজি গার্লসে পড়ি। একাদশ- দাদশ শ্রেণি পড়েছি চাকদা রামলাল অ্যাকাডেমিতে।
গান ছাড়া আর কী ভালো লাগে?
দেয়াশিনী: আঁকতে ভালো লাগে। লতাজি, রবীন্দ্রনাথ থেকে সুশান্ত সিং রাজপুত, অনেকেরই ছবি এঁকেছি দেখে দেখে। (হাসি)।