একটা মাঝারি ফেসবুক পোস্ট। আর সেটাই এখন রাজ্য–রাজনীতিতে তুমুল আলোড়ন ফেলে দিয়েছে। হিন্দু–মুসলমান বিভাজন নিয়ে যখন গোটা দেশের বাতাবরণ সরগরম তখন এমন একটা পদক্ষেপ বিবেককে নাড়িয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ একজন ব্যক্তি যাঁর জন্ম মুসলমান পরিবারে হলেও কর্ম হিন্দু মন্দির নিয়ে এবং নিজের কর্মের জন্যই রাষ্ট্রপতি সম্মান পেয়েছিলেন। আজ যখন গোটা দেশে এমন অস্থির পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে হিন্দু–মুসলমান বিভাজন নিয়ে তখন সেই সম্মান ফিরিয়ে দিতে চান তিনি। সেটাই তুলে ধরেছেন নিজের ফেসবুক পোস্টে। যা নিয়ে এখন চর্চা তুঙ্গে উঠেছে।
এদিকে শৈশব থেকেই তাঁর কর্ম হয়ে উঠেছিল প্রাচীন হিন্দু মন্দিরের সংরক্ষণ। শুরুতে তাঁকে অনেক রক্তচক্ষুর মুখোমুখি হতে হয়েছিল। সমস্যা তৈরি হয়েছিল। কাজে বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। এতকিছুর পরও নিজের কাজকে বাধার জন্য সরে আসেননি তিনি। সবকিছু উপেক্ষা করে মেদিনীপুর শহর থেকে কয়েক কিমি দূরে কংসাবতী নদীর পাড়ে পাথরায় তাঁর হাত ধরেই ‘জীবন্ত’ হয়ে উঠেছিল হিন্দুদের ভেঙে পড়া প্রায় ৪২টি প্রাচীন মন্দির স্থাপত্য। যা মাকরা পাথরে তৈরি এবং টেরাকোটার কারুকাজ ইতিহাসকে সামনে নিয়ে এসেছিল। সেই সূত্রেই গড়ে ওঠে ‘মন্দিরময় পাথরা’। আর তাই সম্প্রীতির অনন্য নজির গড়ে তোলায় ১৯৯৪ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শঙ্করদয়াল শর্মা ‘কবীর সম্মান’ পেয়েছিলেন তিনি। এখন সেই রাষ্ট্রপতি সম্মান ফেরাতে চলেছেন ইয়াসিন পাঠান।
অন্যদিকে ফেসবুক পোস্টে বিষয়টি তুলে ধরায় তা চাউর হতে বেশি সময় নেয়নি। আর তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা শুরু হয়েছে। ঠিক কী লিখেছেন ইয়াসিন পাঠান? আজ, বৃহস্পতিবার ইয়াসিন পাঠান ফেসবুকে লেখেন, ‘১৯৯৪ সালে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, ঐক্য এবং সংহতি রক্ষার স্বীকৃতি স্বরূপ আমি পেয়েছিলাম মহামহিম রাষ্ট্রপতি প্রদত্ত কবীর সম্মান পুরস্কার। আজ সারা দেশে সম্প্রীতি ও ঐক্য ধ্বংস হচ্ছে রাজনীতির জন্য। আমার প্রাপ্ত এই সম্মান পুরস্কার আমি ফেরত দিতে চাই। বাহান্ন বছর ধরে ধ্বংসপ্রাপ্ত ৪২টি প্রাচীন মন্দির স্থাপত্য রক্ষা করছি। বড়ই ভুল করে ফেলেছি। ক্ষমা করো দয়াময় ঈশ্বরে আল্লাহ। ২০০৩ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রকের আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া কর্তৃপক্ষ পশ্চিম মেদিনীপুর ঐতিহাসিক মন্দিরময় পাথরা অবস্থিত ৪২টি ভগ্ন মন্দিরের মধ্যে ৩৪টি মন্দির এবং মন্দির সংলগ্ন ৯ একর ৯৭৫ ডিসমল জমি অধিগ্রহণ করেছিলেন সেই জমির মূল্য জমির চাষীরা আজও পাননি। এএসআই বনাম রাজ্য তথা জেলা প্রশাসনের ভূমি দফতর জমির বিষয়ে। দড়ি টানাটানি চলছে। দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হওয়াকে আমি মান্যতা দিতে এবং ২৩ বছর ধরে জমি অধিগ্রহণের মূল্য না পাওয়ার জন্যই আমার পাওয়া মহামহিম রাষ্ট্রপতি প্রদত্ত কবীর সম্মান পুরস্কার ফেরত দেওয়ার জন্য এই আবেদন।’
আরও পড়ুন: একই পরিবারের তিনজন সদস্যের দেহ উদ্ধার গোঘাটে, কেন এমন ঘটল? তদন্তে পুলিশ
পাথরার পাশেই অবস্থিত হাতিহল্কা গ্রাম। এখানেই বেড়ে ওঠা ইয়াসিন পাঠানের। কদিন ধরে বাংলার কয়েকটি এলাকায় হিংসার ঘটনা ঘটেছে। আর তাতেই হতাশ ৭২ বছরের ইয়াসিন। তিনি সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, ‘ছোটবেলা থেকে হিন্দুদের মন্দির সংরক্ষণে হাত লাগিয়েছিলাম। ভাবিনি কখনও এই দিনটা দেখতে হবে। রাজনীতির জন্যই ধ্বংস হচ্ছে দেশের সম্প্রীতি আর ঐক্য। এমন চলতে থাকলে দুই সম্প্রদায়ের মানুষ কীভাবে বাঁচবে কে জানে! আগামী ৩ মে আমার জীবনী নিয়ে নাটক হচ্ছে অশোকনগরে। তাই উদ্যোক্তারা আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। কিন্তু সাহস পাচ্ছি না ওখানে যাওয়ার। আর শরীর সঙ্গ দেয় না। হার্ট ব্লক, কিডনিতে সমস্যা আছে। সামান্য পেনশন পাই। টাকা চলে যায় ওষুধ কিনতে। আর এভাবে ভাইয়ে ভাইয়ে বিভেদ দেখলে খুব কষ্ট লাগে। তাই ঠিক করেছি রাষ্ট্রপতির দেওয়া কবীর সম্মান ফিরিয়ে দেব।’