বাড়ি থেকে অফিস, খেলার ময়দান থেকে ব্যবসা বর্তমান সময়ে মহিলারা পিছিয়ে নেই কোনও কিছুতেই। কিন্তু যেখানে দাঁড়িয়ে আজও কোথাও গিয়ে শুনতে হয় ‘বাঙালিদের দ্বারা ব্যবসা হয় না’, সেখানে নারী দিবসের ঠিক প্রাক্কালে ৯-৫ টার সিকিওর জীবন ছেড়ে শূন্য থেকে ব্যবসা শুরু করার লড়াইটা কেমন ছিল সেটাই হিন্দুস্থান টাইমসকে শোনালেন ডক্টর মহুয়া দত্ত। এই বিষয়ে জানিয়ে রাখা ভালো, মহুয়া দুই দশকের বেশি সময়ের অধ্যাপনার জীবন ছেড়ে চকলেটের ব্যবসা করেছেন।
নিশ্চিন্ত, নিরাপদ অধ্যাপনার জীবন ছেড়ে ব্যবসা কেন?
ডক্টর মহুয়া দত্ত: গত ২০ বছরের বেশি সময় ধরে ৯-৫ টার চাকরিই করেছি। একটি কলেজের প্রফেসর ছিলাম, যখন রিজাইন করি তখন অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টর পদে আসীন। ফুলটাইম চাকরি থেকে ব্যবসায় সরে আসার দু-তিনটে কারণ আছে। প্রথমত হল স্বাধীনতা। নিজের মতো করে কাজ করতে চেয়েছিলাম, বা চাই। একই সঙ্গে করোনার সময়, সব কিছুর আগে মানুষের জীবন, আর তার থেকেও বেশি জরুরি পরিবার এবং তাদের সময় দেওয়া এই ভাবনা, ধারণাটাও যেন আরও পোক্ত হয়। আর স্বাধীনতা থাকার অর্থ আমি নিজে ঠিক করতে পারি যে আমি কতটা কাজ করব, কতটা সময় পরিবারকে দেব। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে ব্যবসা করতে গেলে শুরুর দিনগুলোতে পরিবারকে সময় দেওয়াটা একটু কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু তাও, আমি এটা জানি যে কোনও বিপদ এলে, ইমারজেন্সি পরিস্থিতি হলে সেখানে যেতে পারব। দ্বিতীয়ত, আমি এই ব্যবসাটা শুরু করেছি মানুষের জীবনে বদল আনার জন্য। আমার কাছে যাঁরা কাজ করেন তাঁরা সবাই পরিচারিকা এবং তাঁদের সন্তানরা। তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মকে যাতে আমি একটু ভালো জীবন দিতে পারি সেটার চেষ্টা করি। আমি বস্তি থেকে তাঁদের এক একজনকে নিয়ে আসি, কাজ শেখাই এবং তাঁরাই আমাদের জন্য কাজ করেন। আমার জীবনের উদ্দেশ্য এটাই, আমি যতদিন কাজ করব ততদিনে যেন আমি অন্তত কিছু মানুষের রুটিরুজির পাকাপাকি ব্যবস্থা করে যেতে পারি। ৯-৫ টার চাকরি জীবনে এই থ্রিল, এই মজা, এই ওঠাপড়াগুলো নেই। পুরো জিনিসটাই ওখানে ভীষণ ছকে বাঁধা, গতানুগতিক। ওখানে আমি থাকলেও হবে, না থাকলে আমার জায়গায় আরেকজন কাউকে দিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু এখানে ভালো কিছু হলে সেটাও আমার, খারাপ হলে সেটাও আমার।
আরও পড়ুন: দেয়াশিনী এবং অতনুর দখলে এবারের সা রে গা মা পা -এর বিজয়ীর খেতাব! আরাত্রিকা, সাঁই, অনীকরা কে কী হলেন?
‘বাঙালির দ্বারা ব্যবসা হয় না’, এই প্রচলিত ধারণা সম্পর্কে আপনার কী মত?
ডক্টর মহুয়া দত্ত: ইতিহাস কিন্তু অন্য কথা বলছে। ব্যবসায় বাঙালি এককালে বিশাল কাজ করেছে যে সেটা প্রমাণিত। এমনকি পৌরাণিক কাহিনিতেও চাঁদ সদাগর, প্রমুখের উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু এখন এই কথাটা এই জন্য প্রচলিত হয়েছে কারণ বাঙালিরা অতিরিক্ত নিরাপত্তা-প্রিয় হয়ে গিয়েছে। তাঁরা হয়তো চান পুরো জিনিসটা নিরাপদ, নিশ্চিন্ত, ‘সেট’ থাকবে। মাস গেলে মাইনে পাব, এই মানসিকতা চলে এসে এখন। এটার কারণ বাংলা ভাগ থেকে শুরু করে অনেক কিছু হতে পারে। বাঙালিরা অনেক ভুগেছে, অর্থনীতির অনেক ওঠাপড়া দেখেছে। সেখান থেকে দাঁড়িয়ে হয়তো এই রিস্ক নেওয়ার জায়গাটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তার মানে এটা না যে বাঙালি ব্যবসা করতে পারে না। বাঙালি হয়তো ওইভাবে ঢাকঢোল পিটিয়ে ব্যবসা করছে না, কিন্তু করছে। ধীরে ধীরে আরও অনেকে বিষয়টা বুঝছেন, ব্যবসায় এগিয়ে আসছেন।
যখন ব্যবসা শুরু করেন, মহিলা হিসেবে কোনও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন?
ডক্টর মহুয়া দত্ত: এটা ঠিক যে কখনও কখনও লোকের কথা শুনতে হয়, ভুলভাল ইঙ্গিত দেওয়া হয় মহিলা বলে। কিন্তু তাও, আমি মহিলা বলে আলাদা করে কোনও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছি বা কিছু অর্জন করে ফেলেছি এটা মনে হয়নি কখনও। অবশ্যই কিছু কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছি, তবে আমার মনে হয় পুরুষ হলে অন্য রকম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতাম।
পৈতৃক ব্যবসাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া একরকম, কিন্তু নিজের কিছু একেবারে শূন্য থেকে শুরু করার লড়াইটা কেমন ছিল?
ডক্টর মহুয়া দত্ত: প্রতিষ্ঠিত কোনও ব্যবসাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মধ্যে অবশ্যই কিছু প্রতিকূলতা থাকে, সমস্যায় পড়তে হয়। কিন্তু শূন্য থেকে কোনও জিনিসকে শুরু করার চ্যালেঞ্জটা পুরোপুরি আলাদা। শূন্য থেকে শুরু করলে যেটা হয়, শেখানোর কোনও লোক থাকে না, কোনও ব্যাকআপ থাকে না, বা থাকে না কোনও রেফারেন্স পয়েন্ট। আমি যে কোনও সিদ্ধান্ত নেব, সেটা করলে কী হতে পারে সেটার কোনও উদাহরণ আমার সামনে থাকে না। তো চ্যালেঞ্জটা মূলত এখান থেকে শুরু হয়। এছাড়া ধার বাকি, কোন ভেন্ডারের থেকে জিনিস নেব, কোন ক্লায়েন্টের সঙ্গে কীভাবে ডিল করতে হবে, কর্মচারী পাওয়া এগুলো তো আছেই। একদম একটা নতুন জিনিস শুরু করলে সেটার জন্য কর্মচারী পাওয়া খুব কঠিন, কারণ তাঁদের আমার ব্যবসা ছাড়া আমার উপরে ব্যক্তি হিসেবে ভরসা রাখতে হবে। আর তাছাড়া...
আরও পড়ুন: শ্রেয়ার কণ্ঠে যেন ফিরলেন খোদ লতা! ইন্ডিয়ান আইডলে ‘লগ যা গলে’র জাদুতে মুগ্ধ শ্রোতারা
কী?
ডক্টর মহুয়া দত্ত: আমার মনে হয়, এই ক্ষেত্রে সবথেকে সমস্যার হল ব্যবসায়ী কমিউনিটিতে আমাদের খুব নিচু চোখে দেখা হয়। অনেকের ধারণা থাকে পৈতৃক ব্যবসা যদি না হয় তাহলে এটা কোনও ব্যবসাই না। আমরা যেন খেলছি, বা আমাদের কোনও কাজ নেই এমন একটা হাবভাব থাকে অনেকের। এটা মানসিক ভাবে খুব পীড়া দেয়। কেউ চট করে কোনও সাজেশন দিতে চায় না, বলে 'করতে করতে শিখে যাবে'। তবে আমি খুব ভাগ্যবান যে আমার আশেপাশে এমন কিছু ব্যবসায়ী পেয়েছি যাঁরা আমাকে খুব সাহায্য করেছেন। কলকাতার ব্যবসায়ী গোষ্ঠী নিয়ে খুব আশাবাদী। এখনও কিছু মানুষ আছেন যাঁরা ব্যবসাকে পেশা হিসেবে বাড়াতে চান। বাকিদের সাহায্য করেন।
ধীরে ধীরে বহু মহিলা ব্যবসাকে পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছেন বা ব্যবসায়ে যুক্ত হতে চাইছেন। তাঁদের কী টিপস দেবেন?
ডক্টর মহুয়া দত্ত: মহিলারা পৃথিবীর সবথেকে কঠিন কাজ ঘর সামলানো খুব সাবলীল ভাবে করতে পারেন। এটা আমি মনে করি। একজন মহিলা যদি একটা পরিবারের বিভিন্ন বয়স, পেশার মানুষকে ম্যানেজ করে চলতে পারেন, তাহলে তাঁর কাছে চাকরি বা ব্যবসা সব জলভাত। আসলে মহিলারা মাল্টি টাস্কিংয়ে ভীষণ ভালো। ব্যবসা বলুন বা চাকরি আপনি যে একজন মহিলা এটা ভুলে যেতে হবে। নিজেকে মানুষ হিসেবে ভাবতে হবে, যে কিনা একাধিক কাজে পারদর্শী। মহিলা বলে আমি কোনও অংশে কম সেটা কিন্তু নয়। এই মানসিকতা রাখলেই হবে।
আরও পড়ুন: নাম না করে ইন্দিরার পুতুলকে কটাক্ষ রানার? কেন লিখলেন, 'ঠগগুলোকে চিনে রাখুন, খালি মিথ্যে ...'