প্রথমে পাঠভবন, পরে কলাভবনে পড়াশোনা। দীর্ঘ ৪০ বছর কলকাতায় চাকরি। কিন্তু শিকড়ের টান ভোলা কঠিন। তাই অবসর পেয়েই শুভলক্ষ্মী গোস্বামী শহর ছেড়ে ফিরে যান শান্তিনিকেতনে। আজও শান্তিনিকেতনের ভালো-মন্দে সোচ্চার হন। কোনও শক্তি গুরুদেবের প্রতিষ্ঠানের ঐতিহ্য ক্ষুণ্ণ করতে চাইলে প্রতিবাদ জানান। ঠিক যেমন নিয়মিত জানাতেন বিশ্বভারতীর প্রাক্তন উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর কার্যকলাপের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি কথা হচ্ছিল পৌষ মেলা নিয়ে। ছোটবেলায় দেখা মেলার আকর্ষণ ফিরে এল তাঁর স্মৃতিমেদুরতায়।
‘রবীন্দ্রনাথকে ২ টাকা দিয়েছিলেন…’
বাবা থাকতেন ঢাকায়।শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠার সময় বাবার কলেজে সাহায্য চাইতে এসেছিলেন বিশ্বকবি। শুভলক্ষ্মীর কথায়, ‘আমার বাবা বটানির অধ্য়াপক ছিলেন। ঢাকার জগন্নাথ কলেজে পড়াতেন। ঘটনাচক্রে সেখানেই বটানি নিয়ে পড়াশোনা বাবার। একদিন ক্লাসে প্রিন্সিপাল এসে জানালেন রবীন্দ্রনাথ আসবেন। তিনি একটা স্কুল স্থাপন করতে চলেছেন বীরভূমের বোলপুরে। তার জন্য যে যেমন পারো অর্থসাহায্য কোরো। আমার বাবা তখনকার দিনে ২ টাকা দিয়েছিলেন । তখন থেকেই শান্তিনিকেতনের সঙ্গে একটা যোগ তৈরি হল। এরপর যখন দাঙ্গা বাঁধল, বিধুশেখর শাস্ত্রী বাবাকে ডাকলেন। বাবা আমাদের নিয়ে শান্তিনিকেতনে চলে এলেন। আমরা তখন খুবই ছোট।’
আরও পড়ুন - যুগ বুঝে আধুনিক হবে পৌষ মেলা, শৈশব স্মৃতিতে ফিরলেন মেলার অন্যতম আয়োজক অনিল কোনার
‘মন্দিরের সামনে তখন মেলা’
পৌষ মেলার সঙ্গে পরিচয় কীভাবে? শান্তিনিকতেনের প্রবীণা আশ্রমিক জানাচ্ছেন, ‘স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে পৌষ মেলার সঙ্গে আলাপ। প্রথম প্রথম কিছু বুঝতাম না। শিক্ষকরা হাত ধরে চেনালেন। রতনপল্লীতে আমাদের কোয়ার্টার। মন্দিরের সামনে তখন মেলা। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন মেলায় গ্রামের সঙ্গে শহরের মিলন হবে। সেটাই আদতে বাস্তবায়িত হয়েছিল। কাঠের চুড়ি, কৃষ্ণনগরের পুতুল, লোহার কড়াই, হাড়ি, জিলিপির দোকান, পাঁপড়ভাজা। আশেপাশের গ্রামের সাওতাঁলরা গরুর গাড়ি করে মাটির হাঁড়ি কলসি নিয়ে আসত। রতনপল্লীর উল্টোদিকের একটা খালমতো জায়গায় গাড়ি তুলে দিয়ে তার নিচে খড় বিছিয়ে নিত। সেখানেই মেলার কয়েকদিন তাঁদের থাকা-খাওয়া।’
‘পৌষ মেলা আমাদের দুর্গা পুজো’
শুভলক্ষ্মীর কাছে পৌষ মেলার গুরুত্ব কতটা, তা ফুটে উঠল এর পরের কথায়। বললেন, ‘কলকাতার মানুষদের কাছে যেমন দুর্গা পুজো, আমাদের শান্তিনিকেতনের আশ্রমিকদের কাছে তেমনই পৌষ মেলা। ৭ পৌষ সপ্তমী, ৮ পৌষ অষ্টমী, এভাবে ১০ পৌষ দশমী ছিল আমাদের কাছে। আপনাদের বাড়িতে পুজোর সময় যেমন অতিথিরা আসেন। তেমনই আমাদের শান্তিনিকেতনে পৌষ মেলায় সমাগম হয় মানুষের। এখন তো প্রচুর হোটেল। তখন এত হোটেল ছিল না। সিংহসদনে বিশাল এলাকাজুড়ে খড় বিছিয়ে তার উপর শতরঞ্চি পেতে দেওয়া হত। মেলায় আসা মানুষরা সেখানেই থাকতেন।’
আরও পড়ুন - ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ শান্তিনিকেতনের প্রথম পৌষ মেলা, ভিন্ন আবেগের সাক্ষী হল HT বাংলা
এসেছিলেন নেহরু, ইন্দিরা
আশ্রমিক শুভলক্ষ্মীর কাছে এখনও স্মরণীয় হয়ে আছে নেহরুর আগমনের দিনটি। ‘পৌষ মেলায় সময় আমরা নেহরু, ইন্দিরাকেও আসতে দেখেছি। তখন আম্রকুঞ্জে সমাবর্তন উৎসব হত। প্রত্যেক পড়ুয়াদের হাতে সপ্তপর্ণী ছাতিমপাতা ও শংসাপত্র তুলে দিতেন নেহরু ও ইন্দিরা গান্ধি। কলাভবনের পড়ুয়া হওয়ার সুবাদে আমিও পেয়েছি সেই শংসাপত্র।’
বাজি পুড়িয়ে জাহাজ কেল্লার যুদ্ধ
মেলার অন্যতম আকর্ষণের প্রশ্নেই বলে উঠলেন, বাজির কথা। ‘তখন বাজি পোড়ানোর খেলা ছিল মেলার বড় আকর্ষণ। আমরা যারা পুরনো লোক, তারা ওই দৃশ্য কখনও ভুলব না। পুরনো মেলার মাঠ যেহেতু ছোট, পূর্বপল্লীর মাঠে বাজি ফাটানো হত। তখন বাজি তৈরি করত সুরুলের লোকরা। বাজি পুড়িয়েই জাহাজ কেল্লার যুদ্ধ দেখানো হত। সে জিনিস সচক্ষে না দেখলে কল্পনা করা কঠিন। বাজি আকাশে গিয়ে ‘বিশ্বভারতী’ লেখা হয়ে যেত। আবার কিছু বাজি গুরুদেবের ছবি এঁকে ফেলছে। এগুলো এখনও চোখে স্বপ্নের মতো ভাসে।’
মেলার চরিত্র পাল্টেছে
তখনকার তুলনায় এখনকার মেলায় কী কী বদল চোখে পড়ে? শুভলক্ষ্মী জানালেন, ‘চার বছর পর নানারকম জটিলতা কাটিয়ে মেলা হচ্ছে শেষ পর্যন্ত। তবে এখন যে মেলা হয়, তার জৌলুস আগের থেকে অন্যরকম। তখন মেলায় যারা আসত, তাদের মধ্যে একটা আন্তরিকতা ছিল। রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে আসছেন বলে একটা ভালো লাগা ছিল, প্রচ্ছন্ন গর্ব ছিল। এখন বেশিরভাগটাই ব্যবসা। তাছাড়া, মেলায় এখন বিভিন্ন ব্র্যান্ডেড সংস্থার স্টল, মোটরসাইকেল, ব্যাঙ্কের স্টল, রাজনৈতিক দলগুলির স্টলের রমরমা। এগুলো পৌষ মেলার সঙ্গে ঠিক মানানসই লাগে না।’