কলকাতার কি বয়স বাড়ছে? পরিসংখ্যান না দেখে এই প্রশ্নের সপক্ষে বা বিপক্ষে কিছু লেখা মুশকিল। কিন্তু কলকাতার বহু মানুষ যে অসহায়, তা বলতে পরিসংখ্যানের হাত ধরতে লাগে না। দুপুরের ব্যস্ত হাওড়া ব্রিজ। প্লাস্টিকের মাল বোঝাই ভ্যান নিয়ে কলকাতা ফিরছেন কঙ্কালসার বৃদ্ধ চালক। দুপুর রোদে প্যাডেলে চাপ দিতে নাজেহাল তিনি, খেয়াল করেননি, কখন ভ্যানের দড়ি আলগা হয়ে গিয়েছে। ব্যস্ত মানুষের মতো ভ্যান থেকে ছাড়া পেয়েই হাওড়ার দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে সব জিনিস। কিছু যাচ্ছে বাস আর চারচাকার নিচে। প্রথম কয়েক সেকেন্ড সব গাড়ি নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে চলে গেল। তারপর এক সহৃদয় বাইক আরোহী বৃদ্ধকে জানালেন, রাশ আলগা হয়ে গিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ভ্যান থেকে নেমে পড়লেন চালক। প্রাণের তোয়াক্কা না করে কুড়োতে থাকলেন সব, রাস্তার মাঝখান থেকেও। ক্ষতি ততক্ষণে অনেকটা হয়ে গিয়েছে। মালিকের কাছে শুধু জবাবদিহি করলেও, যা পূরণ হবে না। বুড়োর কাণ্ড দেখে ওদিকে বাস, বাইক, চারচাকার তালগোল পাকানো হর্ন। কান ফাটিয়ে প্রমাণ দেওয়া ব্যস্ততা। ধীরগতি সহ্য করতে না পেরে হর্নের আওয়াজ কেউ কেউ বাড়াল। শহর ব্যস্ত, কখনও কখনও নির্মমও। বয়স্কদের দেখলে যেন সেই ব্যস্ততা বাড়ে। বেড়ে যায় পৃথিবীর গতি। আর এই সময়গুলো বয়স্কদেরও বেশি করে মনে হয়, কেউ এসে হাত ধরলে বড় ভালো হত…।
আরও পড়ুন - গলা দিয়ে সোজা পেটে টুথব্রাশ! আশঙ্কাজনক অবস্থা থেকে তরুণীর প্রাণ ফেরাল এন্ডোস্কপি
সুতোর আরেক প্রান্ত
সুতোর এক প্রান্তে যদি এই বয়স্করা থাকেন, তাহলে বোধহয় অন্য প্রান্তে আছেন নীলাদ্রির মতো মানুষেরা। নীলাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়। বাইশ বছর ব্যাঙ্কে কাজ করেছেন। বাকি জীবনটাও কাটিয়ে দিতে পারতেন ব্যাঙ্কের আপাত সুখকর নটা-পাঁচটার চাকরিতে। কিন্তু বাবা-মায়ের হঠাৎ চলে যাওয়া নাড়িয়ে দেয় তাঁকে। কিছুটা বেলাইন করে দেয় গতানুগতিক কেরিয়ার-ভাবনা। আর সেখান থেকেই জন্ম শারদ পল্লবের— ‘Autumn Leaves Care’-এর।
‘বিপদে আপদে পাশে থাকতেই…’
নীলাদ্রির কথায়, ‘চাকরি, কেরিয়ার এসবের চক্করে আমরা অনেকেই বাবা-মায়ের থেকে অনেক দূরে চলে যাই এক সময়। এক শহরে, এমনকী এক রাজ্যেও থাকা হয় না অনেক সময়। এখন তো প্রায়ই এক দেশেও থাকেন না বাবা-মা ও সন্তান। ফলে হঠাৎ প্রয়োজনে পাশে এসে থাকাও সম্ভব হয় না। এই পরিস্থিতিতেই মাথায় আসে এমন একটি সংগঠন গড়ে তোলার। যাতে বিপদে আপদে অন্তত পাশে থাকতে পারি।’

কীভাবে শুরু?
কীভাবে শুরু হয়েছিল অটাম লিভসের কাজ? নীলাদ্রি জানাচ্ছেন, ‘প্রথম প্রথম আমরা কয়েকজন মিলে কাজ শুরু করি। পথের ধারে অসহায় বৃদ্ধদের মধ্যে কেউ হয়তো বেশ কয়েকদিন অভুক্ত, কেউ ভুগছেন গুরুতর রোগে। তাদের কাছে পৌঁছে যাই। তার পর দেখলাম, শুধু তারাই নন। ঝাঁ চকচকে বাড়িতে থাকা বয়স্ক মানুষরাও আদতে একা। বিপদে আপদে বা তুচ্ছ প্রয়োজনেও তারা ঠিকমতো সাহায্য পান না। তাই অনেককিছু থেকেও তারা কখনও কখনও অসহায়।’ এই বাস্তব অনুভব করার পর থেকেই শরতের পাতা ধীরে ধীরে পরিনত হতে শুরু করে। আরও বেশি করে পরিষেবা দিতে শুরু করে অটাম লিভস।
কী কী পরিষেবা দেন নীলাদ্রিরা?
ওষুধ পৌঁছে দেওয়া বা রাতে কারও বুকে ব্যথা হলে হাসপাতালে নিয়ে দৌড়ানোর মতো পরিষেবা দিয়ে থাকে অটাম লিভস? ‘ শুধু তাই নয়, বড় থেকে ছোট সবরকম। ছোটখাটো কাজ যা আপাত পক্ষে একজন কমবয়সি নিজে করে ফেলতে পারেন, বয়স্ক মানুষরা অনেক সময় তা পারেন না। বহুক্ষেত্রে রিস্ট ওয়াচের ব্যাটারিও পাল্টে দিতে হয়। কারণ ওই ঘড়ি সারাতে হলে গাড়ি করে তাঁকে যেতে হবে কাছের কোনও দোকানে। তার জন্য ড্রাইভার চাই। সেখান থেকে ঠিক করে আনতে হবে। অথবা রেখে এসে পরে আরেকদিন যেতে হবে নিয়ে আসার জন্য। শারীরিক দুর্বলতা নিয়ে এতটা ঝক্কি পোয়ানোর ক্ষমতা অনেকের থাকে না। অনেক বাড়িতে আবার নারকেল পেড়ে দিয়ে আসার মতো কাজও থাকে! তার জন্যও আমরা লোক পাঠাই।’ জানালেন নীলাদ্রি।

‘সন্তানের মতো হয়ে ওঠার চেষ্টা করি’
উত্তরে শ্রীরামপুর, বারাসত থেকে দক্ষিণে জোকা। পশ্চিমে হাওড়া থেকে পূর্বে বাইপাস সংলগ্ন এলাকা। কলকাতা ও কলকাতার আশেপাশের অনেকটা এলাকা জুড়ে পরিষেবা দিয়ে থাকে নীলাদ্রির স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। কমবেশি পাঁচশো বৃদ্ধ-বৃদ্ধা রোজ নির্ভর করেন ‘সন্তান’ নীলাদ্রির উপর। অটাম লিভসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নীলাদ্রি তাই গর্ব করেই বলেন, ‘আমি হয়তো ওদের সন্তান নই। কিন্তু সন্তানের মতো হয়ে ওঠার চেষ্টা করি। তাই জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ, কিছুতেই না নেই!’