শীতকাল এলেই হঠাৎ সব নিস্তেজ হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে কমে আসে প্রাণ, শুকিয়ে যায় দেহ। পারদ নেমে গেলেও হৃদযন্ত্রের উষ্ণতাটুকু তো ধরে রাখতে হবে। মানুষ তাই ব্যস্ত হয়। মাঠে তাঁবু ফেলে সার্কাস। চিড়িয়াখানায় ভিড়। রাস্তা বা পাড়ার মাঠে ব্যাডমিন্টন। আর সন্ধ্যে নামলে এখানে ওখানে মাচা শো। আলোর ঝলকানি। বড় বড় আর্টিস্টদের মেলা। নিস্তেজ হতে হতে যেন সব থেমে না যায় — দ্বিগুণ উৎসাহে তাই এত উদযাপনের আয়োজন। ২০২০ সালে এক ভাইরাসও এমন শৈত্য এনেছিল। মানুষের হাঁটাচলা, রাস্তার যানজট, বাজারের ভিড় দুদিনের নোটিসে শুষে নিল অজস্র চৌকো চৌকো বাড়িঘরের চৌকাঠ। চারপাশ সুনসান, পথকুকুররা গুলিয়ে ফেলল দিনরাত। জাদুকাঠি ছুঁইয়ে যেন পৃথিবীকে থামিয়ে দিয়েছে কেউ। স্তম্ভন!
জমি দখলের লড়াই
বাস্তবের কাছে আসি। জাদুকাঠি নয়, ছোঁয়ানো হল ভাইরাসের স্পাইক। স্পাইক দিয়ে শ্বাসযন্ত্রের সঙ্গে নিজেকে আঠার মতো আটকে রাখে ভাইরাস। তারপর বিষ ছড়ায়। নিজেও ছড়িয়ে যায়। এক ফুসফুস থেকে অন্য ফুসফুসে। ষড়যন্ত্র ছিল বড়সড়। একটা একটা করে গোটা পৃথিবীর ‘সবচেয়ে বুদ্ধিমান’ প্রজাতির ফুসফুস ‘হাইজ্যাক’ করে ফেলা। হিসেব সহজ, তাদের সংখ্যা যত বাড়বে, ওই ‘বুদ্ধিশ্রেষ্ঠ’ প্রজাতির জনসংখ্যা তত কমবে। এ যেন জমি দখলের লড়াই।
অসীম জমি থেকে নিজের ভাগটুকু
জমি দখলের লড়াই বললে অনেক দৃশ্য মনে ভেসে উঠতে বাধ্য। ট্রেন থামার আগে বা ট্রেন থামতেই উঠে পড়ে যেমন সিট দখলের চেষ্টা। লাইনে অন্যের আগে দাঁড়ানোর বা কোনওভাবে সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা। দোকান বা বাড়ির জমিটা ধরে রাখতে এলাকার ‘দাদা’দের তুষ্ট করা। কর্মস্থানে মালিকের মনে আর বাড়ি ফিরলে আত্মীয়দের মনে জমি দখলের নিরন্তর চেষ্টা। বাড়ি, কর্মস্থান বাদ দিলে যে সমাজ পড়ে থাকে, সে সমাজেও প্রতিনিয়ত জমি দখলের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। সোশ্যালে বা লোকালে, ভোকালে চলে জীবন। চেষ্টা চলে জীবনের জমিও যতটা সম্ভব চওড়া করে নেওয়ার! প্রতিটি জীবন যেন সময়ের অসীম জমি থেকে নিজের ভাগটুকু দখল করে বেঁচে থাকার লড়াই।
এই লড়াইয়েই কি না প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াল ভাইরাস! ভাইরাসের চেয়েও বেশি ভাইরাসের ভয়। একটা পৃথিবীতে ৮৭ লক্ষ প্রজাতির থাকার জন্য কতটা স্থান প্রয়োজন? এই প্রশ্ন কখনই একটি বিশেষ প্রজাতির কপালের ভাঁজ হয়নি। কিন্তু ভাঁজ হয়ে দাঁড়াল করোনা। কখনও দুশ্চিন্তা, কখনও ভয়, কখনও সন্দেহ, কখনও বা বাধভাঙা রাগ হতাশা। ভাঁজের জ্যামিতি বারবার পাল্টে দিয়েছে একটিমাত্র ভাইরাসের বিদ্যুৎতুল্য ‘দিকবিজয়’!
অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখার লড়াই
বিজ্ঞানীদের কথা ধরলে এই জগতে অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখতে মানুষকে প্রতিনিয়ত লড়তে হচ্ছে। এই বহুমুখী লড়াইয়ের একটা দিক অবশ্যই ৮৭ লক্ষ প্রজাতির হাঁ-মুখ। তাদের গ্রাস থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা। বিশ্বখ্যাত পরিচালক তথা সিনেমায় থ্রিলার ঘরানার জনক আলফ্রেড হিচককের ‘দ্য বার্ডস’ মনে পড়ে যায়। সাদা ধবধবে সুন্দর পরিযায়ী পাখি। ঘুণাক্ষরেও যাদের দেখলে রক্তের রং মনে পড়ার কথা নয়। তারা খুনী হয়ে ওঠে। মানুষের মতো শখে নয়, অস্তিত্বরক্ষার তাগিদে। আপাতনিরীহ এমন অনেক জীব ঘুরে বেড়াচ্ছে আশেপাশে। অস্তিত্বের প্রশ্নে যারা সকলে হয়ে উঠতে পারে আগ্রাসী। কেউ কেউ আবার অদৃশ্য়। যেমন করোনাভাইরাস। মজার বিষয়, ৮৭ লক্ষ প্রজাতির মধ্যে হয়তো মশা ছাড়া আর কারও সঙ্গেই আমাদের রুটিন মেনে রোজ লড়াই হয় না!
মহা-দুঃস্বপ্ন যা দিয়ে গেল
প্রাণের স্পন্দন শুনতে বড় সুন্দর। কিন্তু রক্তের গতি ছাড়া সেই আওয়াজ উঠবে কীভাবে? পড়তে অস্বস্তি হলেও রক্তই স্পন্দনধ্বনি তুলছে নিরন্তর। তাই অস্তিত্বরক্ষার লড়াইয়ে রক্তের ভূমিকা থেকে যায়। কখনও ঝরে, কখনও বয়ে যায়, কখনও গড়ে আওয়াজ। করোনার দুঃস্বপ্নে শুধু রক্ত নয়, মিশে ছিল চোখের জল, গাদাগাদা ওষুধ, চিকিৎসকদের বিনিদ্র রজনী ও অগণিত মানুষের ‘নিওনর্মাল লাইফ’ যুদ্ধ।
স্তম্ভন আদতে মৃত্যুর সমতুল্য নয়, মৃত্যুই। কারণ ‘চলাই জীবন থেমে যাওয়াই মরণ’। তার ছিঁড়ে গিয়েছিল বলে মাঝপথেই ছন্দপতন হয়। গান থেমে গিয়েছিল। কিন্তু থেমে গেলে থেমেই থাকবে, তেমন তো নয়। নিঃস্ব না হওয়া পর্যন্ত জীবন থেমে থাকতে দেয় না। ছিন্নবীণা তুলে ফের জীবনের জয়গানে সুর দিল মানুষ। মানুষই মানুষকে গাঢ় অন্ধকারে নতুন করে চেনাল প্রত্যয় ও প্রাণশক্তি। এত স্বজন সম্পর্ক ও ছায়া কেড়ে নেওয়ার বদলে কী দিয়ে গেল মহা-দুঃস্বপ্ন? বোধ করি, হার না-মানা লড়াইয়ের শিক্ষা। রোদে পুড়তে পুড়তে হাঁটার শিক্ষা। ‘জীবনবোধ’ বললেও যাকে ভুল বলা হয় না।