রাজকুমার চক্রবর্তী
‘ইতিহাসে হাতেখড়ি’ শিরোনামে শিশুদের জন্য লেখা তিনটি অন্য ধারার ইতিহাস বই পড়ার সুযোগ হল। বই তিনটির নাম দেশভাগ (লিখেছেন অন্বেষা সেনগুপ্ত), দেশের মানুষ (লিখেছেন তিস্তা দাস) এবং দেশের ভাষা (লিখেছেন দেবারতি বাগচী)। সহজ ভাষায় ও কিছুটা গল্পের ঢঙে তিনটি বইয়ের লেখকই শিশুদের বোঝানোর চেষ্টা করেছেন ‘দেশ’ কাকে বলে, ‘বর্ডার’ কাকে বলে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কীভাবে পালটে যায় ‘বর্ডার’-এর ধারণা, ‘মাতৃভাষার অধিকার’ বলতে ঠিক কী বোঝায়, উদ্বাস্তু জনগণের ‘নাগরিক’ পরিচয় নির্মাণের সমস্যা, রাষ্ট্রীয় আইনকানুনের জটিলতায় আটকে পড়া সাধারণ মানুষের জীবনযন্ত্রণার মতো জটিল বিষয়। বইগুলির পিছনের মলাটে উচ্চারিত হয়েছে এই সংকল্প: ‘ইতিহাসের নানা সময়, নানা জটিল ধারণা সহজভাবে বুঝিয়ে বলাই এই বইগুলোর উদ্দেশ্য’। উদ্যোগ হিসেবে এটি যে অভিনব ও সাধুবাদযোগ্য তা বলে দিতে হয় না।
স্বাধীনতা-উত্তর ভারত একটি গণতান্ত্রিক দেশ রূপে চিহ্নিত। ‘গণতন্ত্র’ বলতে আমরা সকল নাগরিকের সমান অধিকার বুঝি। কিন্তু সত্যিই কি স্বাধীন ভারতে সকল নাগরিক ও সকল জনগোষ্ঠী সমান অধিকার পেয়েছিল? দেশভাগ ভিটেছাড়া করেছিল যাঁদের, তাঁদের জুটেছিল উদ্বাস্তু তকমা। অজানা-অচেনা জায়গায় নিজেদের উদ্যোগে তারা তৈরি করেছিলেন উদ্বাস্তু কলোনি। অনেকের ঠাঁই হয়েছিল সরকারি ক্যাম্পে, শিয়ালদহ স্টেশনে, ফুটপাথে বা খোলা আকাশের নিচে। রাজ্য সরকার তাঁদের পাশে দাঁড়াবে, ঠাঁই জোগাড় আর সামান্য জীবিকার ব্যবস্থা করে দেবে – এই ছিল তাঁদের প্রত্যাশা। অন্বেষা লিখেছেন, ‘তাঁদের তো এই আশা থাকতেই পারে। তাঁরা তো দেশ ভাগ করেননি, করেছিলেন দেশের বড় বড় নেতারা’ (পৃষ্ঠা ৪৬)। কিন্তু সরকার যথেষ্ট সহানুভূতির সঙ্গে ভিটে-ছাড়া মানুষগুলোর বিপন্নতা বোঝবার চেষ্টা করেনি। পূর্ববঙ্গ থেকে আগত উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রকট হয়েছিল এই বাস্তবতা। বাংলার সরকার ঘোষণা করেছিল, ১৯৪৮-এর জুলাই মাস পর্যন্ত যাঁরা এ-দেশে আসবেন তাঁরা নাগরিক হিসেবে গণ্য হবেন। তারপরে আর নয়। অথচ উদ্বাস্তু স্রোত লেগেই ছিল, কারণ দেশভাগের বহুদিন পরেও দাঙ্গা-হাঙ্গামা থামেনি। ‘সব থেকে বেশি গোলযোগ বেঁধেছিল সেইসব মুসলমানদের নিয়ে যাঁরা দেশভাগের সময়ে লড়াই-মারামারির জেরে ভারত থেকে চলে গিয়েছিলেন পাকিস্তানে, তারপর নানা কারণে আবার ফিরে এসেছিলেন ভারতে। … তাঁরা তো উদ্বাস্তু নন, তাঁরা যে নিজেদের দেশেই ফিরছেন। এই মানুষগুলো সরকারি চোখে বেআইনি মানুষ হয়ে গেলেন। সরকারি ভাষায় এরা অনুপ্রবেশকারী মানে যারা অন্য দেশ থেকে এসেছেন, কিন্তু না তারা উদ্বাস্তু, না তাদের আছে এই দেশে ঢোকার কোনো অনুমতি’ (তিস্তা, পৃষ্ঠা ২১-২২)। এই ভাবে স্বাধীন ভারতে তৈরি হয়েছিল অধিকার ও পরিচয়ের বৈষম্য: পূর্ণ নাগরিক অধিকার সম্পন্ন মানুষ, উদ্বাস্তু এবং অবৈধ ‘অনুপ্রবেশকারী’। উদ্বাস্তু জনগণের মধ্যেও সরকারি নীতির তারতম্য প্রকট হয়েছিল। উচ্চবর্ণের ‘ভদ্রলোক’ উদ্বাস্তুদের প্রতি সরকারের ছিল এক-রকম দৃষ্টিভঙ্গি, নিম্নবর্ণের সাধারণ চাষিবাসী মানুষের প্রতি আর-এক রকম। শেষোক্ত মানুষদের ‘ওড়িশা, বিহার থেকে শুরু করে সুদূর উত্তর ভারত, গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ বা দক্ষিণ ভারত’-এ পাঠানো হয়েছিল। আন্দামানের মতো ‘সাত-সমুদ্র তেরো নদীর পারে’র জঙ্গল পরিকীর্ণ দ্বীপপুঞ্জেও পাঠানো হয়েছিল অনেককে। আন্দামানে যাওয়াআসার একমাত্র উপায় সরকারি জাহাজ। তাই ‘সেখানে পৌঁছে ভাল না লাগলেও পালিয়ে আসার জো' ছিল না। এ ছিল একপ্রকার ‘বন্দীদশা’। অন্বেষা তাঁর বইতে মনে করিয়ে দিয়েছেন,
‘… এই বন্দীদশা সবার জন্য নয় কিন্তু। কোনও ডাক্তার, কবিরাজ, মাস্টার, ব্যবসায়ী বা জমিদারকে কিন্তু আন্দামানে পাঠানো হয়নি। পাঠানো হয়েছিল শুধু খেটে খাওয়া চাষি, জেলে, কামার, মিস্ত্রিদের। এই গরিব উদ্বাস্তুদের প্রায় সবাই ছিল দলিত, আর বড়লোক উদ্বাস্তুরা প্রায় সবাই সমাজের চোখে ‘উঁচু জাত’। বুঝতেই পারছ যে দেশভাগের অভিজ্ঞতা এক এক মানুষের কাছে এক এক রকম। মেয়েদের একরকম, গরিব মানুষের একরকম, পঞ্জাবে আর বাংলায় আবার ভিন্ন ভিন্ন, আর জাতপাতের বিচারেও এক এক জনের এক এক রকম' (পৃষ্ঠা ৪৮)।
ইতিহাসের বইগুলিতে বহুদিন পর্যন্ত দেশভাগের ইতিহাস বলতে কংগ্রেস-মুসলিম লীগের দলাদলি আর ব্রিটিশের বিভেদ ও শাসন নীতির কথা আমরা পড়ে এসেছি। সে ইতিহাসে সাধারণ মানুষের ঠাঁই ছিল না। ইদানীং ইতিহাসবিদ্যায় ঝোঁকবদল হয়েছে। সাধারণ মানুষ ও জনজীবনের উপর দেশভাগের অভিঘাত ঐতিহাসিকদের এখন আগ্রহের বিষয়। আলোচ্য বইগুলিতেও সেই নতুন ধারার ইতিহাসের পরিচয় লক্ষণীয়। দেশভাগের অভিঘাতকে জীবন্ত করে বোঝবার ও বোঝাবার তাগিদে তিস্তা ও অন্বেষা ব্যক্তিমানুষের অভিজ্ঞতাকেও ইতিহাসের পরিসরে ঠাঁই দিয়েছেন। অন্বেষা তুলে ধরেছেন দেশরাজ নামে বারো-চোদ্দ বছরের এক কিশোরের পশ্চিম পঞ্জাবের একটি গ্রাম থেকে ভিটেমাটি ছেড়ে অজানা-অচেনা অঞ্চলের উদ্দেশে পাড়ি দেওয়ার করুণ কাহিনি। ময়মনসিংহের জমিদার বাড়ির কন্যা ‘বীথি দিদিমণি'-র জীবন সংগ্রামের কথাও প্রসঙ্গত এসেছে। অন্বেষার ভাষায়, ‘এঁদের জীবনে দেশভাগের শুরু ১৯৪৭ সালে ঠিকই, কিন্তু শেষ যেন এক এক জনের জন্য এক এক সময়ে। তবে কী আশ্চর্য মনের জোর এই মানুষগুলোর! হাল ছেড়ে দেননি তাঁরা কখনও। খুঁজে বেড়িয়েছেন কোথায় একটু কাজের সুযোগ আছে, মাথা গোঁজার ঠাঁই আর দু’মুঠো ভাত’ (পৃষ্ঠা ৪৯)। বীথি যেমন কলকাতায় এসে অনিশ্চিত বিপন্নতার মধ্যেও পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছিলেন এবং কলেজ পাশ করে দিদিমণির চাকরি নিয়ে পরিবারের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। অন্বেষা লিখেছেন:
‘হাজার অসুবিধা, দুঃখের মধ্যেও দেশভাগ কিন্তু বীথির মতো মেয়েদের জীবনে একটুকরো রোদ্দুর নিয়ে হাজির হয়েছিল। দেশভাগই একভাবে দেখতে গেলে বহু মেয়েকে গ্রাম থেকে শহরে, বা বাড়ির অন্দরমহল থেকে আপিস-কাছারিতে পৌঁছে দিয়েছিল। ছেলেতেমেয়েতে যে তফাৎ নেই, সকলেই চাকরি করতে পারে, পরিবারের দায়িত্ব নিতে পারে, লেখাপড়ায় একইরকম ভাল হতে পারে, তা বীথির মতো বাড়িতে দেশভাগ না হলে বোধহয় কেউ বুঝতেই পারত না।‘ (পৃষ্ঠা ৪২-৪৩)

অন্বেষা সেনগুপ্ত, ইতিহাসে হাতেখড়ি: দেশভাগ (কলকাতা: আই ডি এস কে: ২০২২)
‘বর্ডার’ তো শুধু দুটো রাষ্ট্রের মধ্যে থাকে না, রাষ্ট্রের ভিতরেও থাকে। দেশের মধ্যেকার, বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের সীমানা টানার গল্পটি শুনিয়েছেন দেবারতি বাগচী। ভাষা দিয়ে 'সীমানা' টানার এই কাহিনিতেও আছে অনেক ভাঁজ। কখন যে মানুষের কোন আত্মপরিচয়টা বড় হয়ে ওঠে, এবং সেই পরিচয়ের নিরিখে সে ‘সীমানা’ টানতে চায়, বলা মুশকিল। ১৯৪৭ সালে ধর্মের পরিচয়টা মুখ্য হয়ে উঠে ভারত ও পাকিস্তান দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল। 'ভাষার ঐক্য' ভুলে বাংলাও দ্বিখন্ডিত হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে। অথচ, পাকিস্তানে ধর্মের ঐক্য দীর্ঘস্থায়ী হতে পারল না। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দু চাপিয়ে দেবার বিরুদ্ধে উত্তাল হয়ে উঠল বাংলাভাষী পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ। ১৯৫২-র ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা ও স্বীকৃতির দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের বিরাট সমাবেশে গুলি চলল। শহিদ হলেন অনেকে। ভারতেও ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের (দেশের মধ্যে ‘সীমানা’ টানার) জন্যে আন্দোলন গড়ে উঠল। আন্দোলনের চাপে ১৯৫৬ সালে কেন্দ্রীয় সরকার ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনকে স্বীকৃতি দিয়ে আইন পাশ করল। আইনে বলা হল, যে-অঞ্চলের সবচেয়ে বেশি মানুষ যে-ভাষায় কথা বলেন সেই অনুযায়ীই তৈরি হবে নতুন রাজ্য। ইতিবাচক পদক্ষেপ ছিল নিশ্চয়। কিন্তু এতে করে বহুভাষাভাষী আমাদের দেশে কি ভাষার সমস্যা পুরোপুরি মিটল? দেবারতি মনে করিয়ে দিয়েছেন, রাজ্যের মধ্যেও বহু ভাষাভাষী মানুষ থাকেন এবং তাঁদের মধ্যে বৈষম্য থেকে যায়।
"যে ভাষার মানুষের ক্ষমতা বেশি, তাঁরা বাকিদের দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করে, যাতে নিজেদের ক্ষমতা টিকে থাকে।... বঙ্গভঙ্গের সময় শিক্ষিত হিন্দু বাঙালি বাকিদের থেকে ক্ষমতার উপরে, তাই তাঁদের দাবি অন্যদের উপর চাপিয়ে দেবার জোরও ছিল বেশি।... একই ভাবে, দেশভাগ হওয়া মাত্র যেই পাকিস্তানের হাতে ক্ষমতা এল, উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেন তাঁরা। অসমকে যখন বাংলায় আনা হল, বাংলা চাপানো হল অসমীয়াদের উপরে। অনেক পরে যখন অসম আলাদা রাজ্য হল, তখন সেই একই কাণ্ড করল অসমের সরকার। বাঙালিরা সংখ্যায় কম, তাই অসমীয়া চাপান হল বাঙালির উপর। এই ভাবে ক্ষমতার ওঠানামাও চলতে থাকে, আর ভাষার লড়াইয়ের ইতিহাসও নতুন নতুন বাঁক নেয়' (দেবারতি, পৃষ্ঠা ৪৯)
অসমের প্রসঙ্গ এই সিরিজের তিনটি বইতেই ঘুরে ফিরে এসেছে। একই রাজ্যের মধ্যে দুই ভাষাভাষী মানুষের দ্বন্দ্বের উদাহরণ হিসেবে দেবারতি অসমে অসমীয়াভাষীদের সঙ্গে বাংলাভাষী মানুষের সংঘাতের কথা লিখেছেন। প্রথম দিকে ইংরেজ প্রশাসন অসমীয়াকে স্বতন্ত্র ভাষা বলে স্বীকার করেনি। লেখাপড়া ও কাজের ভাষা হিসেবে অসমে তারা বাংলা চালু করেছিল। এর সূত্র ধরেই বাংলাভাষী মানুষের আধিপত্য তৈরি হয় অসমে। এদিকে ১৮৫০-এর দশকে মিশনারিদের উদ্যোগে বানান, হরফ ও ব্যকরণের নিয়মে বাঁধা অসমীয়া ভাষা তৈরি হল। অতঃপর শিক্ষিত অসমীয়াভাষী মানুষ তাঁদের ভাষাকে স্বীকৃতি দেবার দাবিতে শুরু করলেন আন্দোলন। ১৮৭৩ সালে অসমীয়াকে স্বতন্ত্র ভাষার মর্যাদা দিল ইংরেজ সরকার। কিন্তু অসমের মধ্যে তো বাঙালি ও অন্য ভাষাভাষী মানুষও ছিলেন। অসমের দক্ষিণের সিলেট ও কাছাড় জেলায় ছিল বাংলাভাষী মানুষেরই আধিপত্য। অসম প্রদেশে অসমীয়াভাষীদের অস্মিতায় তাঁরা ক্ষুব্ধ হলেন। অসম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলা প্রদেশের অংশভাক হওয়াই তাঁদের কাছে অভিপ্রেত ছিল। কার্জনের বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫) ছিল তাঁদের কাছে আশীর্বাদ। ১৯১১-তে বঙ্গভঙ্গ রদ হল। সিলেট ও কাছাড় ফের ফিরে গিয়ে পড়ল অসমে। অসমের মধ্যে বাঙালি-অসমীয়া বিরোধের খিঁচ রয়েই গেল। ১৯২০-র দশক থেকে দেখা দিল আর-এক সমস্যা। পূর্ববাংলা থেকে একদল বাঙালি কৃষক এসে অসমে গিয়ে বসতি গড়ে তুললেন। অসমীয়া শিখে এঁরা নিজেদের অসমীয়া বলে পরিচয় দেওয়া শুরু করেছিল। আদি অসমীয়ারা এঁদের দেখেছিলেন জীবন-জীবিকার বিরুদ্ধে আঘাত হিসেবে। ১৯৪৭-এ দেশভাগের ফলে কাছাড় ও সিলেট পূর্ব পাকিস্তানে চলে গেলে অসমীয়াভাষীদের স্বস্তি হয়। বাঙালি অধ্যুষিত বরাক উপত্যকা থেকে গিয়েছিল অসমে। ১৯৬১ সালে যখন অসম সরকার অসমীয়াকে রাজ্যের সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করে, বরাক উপত্যকার বাঙালিরা ক্ষুব্ধ হন। বাংলা ভাষার দাবিতে শুরু হয় তাঁদের আন্দোলন। ১৯৬১-র ১৯ মে এগারো জন বাঙালি প্রাণ দিলেন পুলিশের গুলিতে। এই ঘটনার পর অসম সরকার পিছু হঠতে বাধ্য হয়। বরাক উপত্যকার সরকারি ভাষা রূপে বাংলাকে মেনে নেওয়া হয়েছিল।
বাঙালি বনাম অসমীয়া এই দীর্ঘ বিরোধকেই আরও জটিল করেছিল দেশভাগ-উত্তর পরিস্থিতি, যা তিস্তা দাস ও অন্বেষা সেনগুপ্তর বইতে উল্লিখিত হয়েছে। প্রসঙ্গত অন্বেষা লিখেছেন করিম নাসিরের দুর্ভাগ্যের কাহিনি। দেশভাগের বহু পূর্বে নাসিরের পরিবার ময়মনসিংহ ছেড়ে অসমে গিয়ে বসবাস শুরু করেছিল। সে হয়ে উঠেছিল অসমেরই স্থায়ী বাসিন্দা। কিন্তু দেশভাগ তাঁর বা তাঁর মতো মানুষের জীবনে বিপর্যয় নিয়ে এল। অসম জুড়ে শুরু হল ‘বিদেশি হটাও’ আন্দোলন। নাসিরের পরিবারের যেহেতু আদি বাড়ি ময়মনসিংহ, যা পূর্ব পাকিস্তানে পড়েছিল, এবং ধর্মে যেহেতু সে মুসলমান, তাই তাকে 'বিদেশি' বলে দেগে দিয়ে ভিটেমাটি ছাড়া করা হল। ‘নাসিরকে তাঁর অসমের বাড়ি আর তাঁর সাধের ধানক্ষেত ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিল ময়মনসিংহে। মাঝে মাঝে তিনি হেঁটে হেঁটে চলে যেতেন দু’দেশের সীমানা পর্যন্ত; অসমের ধানক্ষেতের দিকে তাকিয়ে চোখ ভিজে আসর তাঁর’—বড়ো দরদ নিয়ে অন্বেষা কথাগুলি উচ্চারণ করেছেন। নাসিরের মতো এমন দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছিল আরও কতজন!
তিস্তা লিখেছেন গঙ্গাধর প্রামাণিক ও হাসিনা ভানুর কথা। দেশভাগ, উদ্বাস্তু জনস্রোত যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও ঘৃণার পরিবেশ জন্ম দিয়েছিল, এঁরা হয়েছিলেন তারই বলি। সেই সঙ্গে ছিল সরকারি নিয়ম-কানুনের ফাঁস। গঙ্গাধরের বাড়ি ছিল বাঁকুড়ার রাধানগরে। সেখান থেকে সে অসমে গিয়েছিল কাজ করতে। নাগরিকত্ব পরিচয় নিয়ে যখন কড়াকড়ি শুরু হল, তখন অসম সরকার তাকে বাংলাদেশী ভেবে গোয়ালপাড়া ক্যাম্পে আটকে করে। কতদিন আগে বাঁকুড়া ছেড়েছিল সে। সঙ্গে কি আর পরিচয়ের প্রমাণপত্র থাকা সম্ভব? সে তো ভেবেছিল, নিজের দেশের মধ্যেই এক জায়গা থেকে আর এক রাজ্যে যাচ্ছে। সেখানে গিয়ে তাকে একদিন নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হবে, এ তো আর ভাবেনি। ফলে গঙ্গাধর নিজের দেশেই হয়ে গেল 'বিদেশি'। চার বছর ডিটেনশন ক্যাম্পে আটক ছিল সে। হাসিনা ভানুর কপাল ছিল আরও খারাপ। কাগজপত্র ছিল হাসিনা ভানুর, সরকারের কাছে জমাও দিয়েছিল এবং তার সুবাদে ২০১৬ সালে তার নাগরিকত্ব মেনে নেওয়া হয়। কিন্তু ২০২১ সালে ফের হাসিনাকে সন্দেহ করা শুরু হল। ইতিমধ্যে কাগজপত্র হারিয়ে ফেলেছে সে। 'বিদেশি' বলে তেজপুর ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দি করা হল তাকে। বেশ কিছুদিন পরে হাসিনার কাগজপত্র খুঁজে পাওয়া যায়। দেখা যায় যে অসমের বড়পেটা জেলায় তার জন্ম। অর্থাৎ সে 'বিদেশি' বা 'অনুপ্রবেশকারী' নয়। মুক্ত হল সে। কিন্তু ওই ক'বছরের অভিজ্ঞতা তার শরীর ও মন ভেঙে দিয়েছিল। স্বাভাবিক জীবনে আর ফিরতে পারেনি হাসিনা ভানু। তিস্তা লিখেছেন, ‘গঙ্গাধর আর হাসিনার কথা পড়ে তোমরা বুঝতেই পারছ, কিছু মানুষকে নাগরিক হতে গেলে অনেক সময় কত লড়াই করতে হয়, কত বছর ধরে লড়াই চলে। এ লড়াইটা বিশেষ ভাবে বোঝা যায় দেশের সীমার আশপাশের এলাকায়’ (পৃষ্ঠা ৪২-৪৩)।
অন্বেষা তাঁর বইয়ের শেষভাগে লিখেছেন,
“ইতিহাসে তো রাজারাজড়াদের নামই আমরা পড়ি, আর পড়ি নেতাদের নাম। কিন্তু এই অচেনা অজানা মানুষদের রোজকার কষ্ট, লড়াই আর আনন্দও কিন্তু একইরকম জরুরি মনে রাখা। দেশভাগের ইতিহাস কেউ জানতে চাইলে তোমরা র্যাডক্লিফ সাহেবের কথা অবশ্যই বোলো। বোলো জিন্নাহ আর নেহরুর কথাও। কিন্তু পাশাপাশি দেশরাজ, নাসির, বীথি বা আন্দামানের মানুষগুলোর কথাও বলতে ভুলো না যেন। আর জয়মণি (একটি হাতি) তো আছেই। এদের সবার গল্পেই টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে আছে দেশভাগের ইতিহাস" (পৃষ্ঠা ৪৯)।
দেশভাগের এই ইতিহাসের সঙ্গে রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব সংক্রান্ত বিবিধ ও নিত্যনতুন নতুন নিয়ম-কানুন আর তার ফাঁসে আটকা পড়া সাধারণ মানুষের বিড়ম্বনার কাহিনিও যুক্ত, তিস্তা যার বিবরণ দিয়েছেন। সি-এ-এ (CAA) ২০১৯, এন-আর-সি (NRC) বা জাতীয় নাগরিক পঞ্জি নিয়ে আলোচনার শেষে তিস্তা মন্তব্য করেছেন,
‘… একটা মস্ত ছাঁকনি সব সময় যেন তাড়া করছে। ১৯৪৭, ১৯৫৫, ১৯৭১, ১৯৮৬, ২০০৩, ২০০৫, ২০১৫, ২০১৯ – সাধারণ নাগরিকের প্রমাণপত্র, নানা মাপের কাগজ জমানোর গল্প যেন ফুরোতেই চায় না। নাগরিকত্ব আর তার ছাঁকনি যেন জীবনের সবচেয়ে বড়ো পরীক্ষা এই মানুষদের জীবনে। ছাঁকনিতে আটকে পড়লেই হল! এই ছাঁকনি যেন দেশের মানুষকে বিপদে না ফেলে, সেই চেষ্টা করে যাওয়া আমাদের সকলের কাজ, সকল নাগরিকের দায়িত্ব।‘ (পৃষ্ঠা ৪৯)
ছোটোদের জন্য লেখা উৎকৃষ্ট ‘ইতিহাস’-এর নমুনা হিসেবে এই তিনটি বই দাবি করতেই পারে। ‘ইতিহাস’ নিয়ে সাধারণ পাঠকের অভিযোগের অন্ত নেই। এখনও ইতিহাস বলতে অধিকাংশজন বোঝেন রাজা বা ‘বড়ো মানুষ’-দের কীর্তিকলাপ ও যুদ্ধজয়ের বর্ণনা। ইতিহাসের বাজার-সফল নোটবইগুলিতে চোখ বোলালেই দেখা যাবে তথ্যের স্তুপ, এক-দুই-তিন করে ‘পয়েন্টস’-এর সারণী এবং ঐতিহাসিকদের গুরুগম্ভীর কোটেশন। এই ‘ইতিহাস’ যে ‘কী-কামে-লাগে’ বুঝে উঠতেই ছাত্রদের নাভিশ্বাস উঠে যায় এবং উত্তর-জীবনে তারা ইতিহাস-বিমুখ হয়ে পড়ে। ‘ইতিহাসের হাতেখড়ি’ সিরিজটি সে-ক্ষেত্রে প্রকৃত ইতিহাসের মনোগ্রাহী দৃষ্টান্ত হিসেবে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়। অন্বেষা সেনগুপ্ত ঠিকই লিখেছেন, ‘ইতিহাস তো আর শুধুই কবে, কী ঘটেছে তার ফর্দ নয়। ইতিহাস মানে কোনও পুরনো ঘটনাকে নানাভাবে বোঝার চেষ্টা করা। সেই ঘটনা কীভাবে ঘটল, কেন ঘটল, তার ফলে কী হল, এই সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজ করা’ (পৃষ্ঠা ১৭)। ‘নানাভাবে’ শব্দপ্রয়োগটি লক্ষণীয়। সিরিজটির তিন লেখক মিলে ‘ইতিহাস’-কে ‘নানাভাবে বোঝা’-র চেষ্টাই করেছেন, এবং সেই 'বোঝার সময়' তাঁদের সংবেদনশীল ও মানবিক মনটি সর্বদা সক্রিয় ছিল। ঐতিহাসিকের সংবেদনশীল মানবিক মনটি ইতিহাসচর্চায় খুবই প্রয়োজনীয়ও বটে। না হলে সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষাগুলো দৃষ্টির বাইরে থেকে যায়। ‘ইতিহাস’ বলতে তখন আমরা বুঝি রাষ্ট্রের দাপাদাপি ও শক্তিপ্রদর্শন—সে-ইতিহাসে সাধারণ মানুষের রক্তক্ষরণ যদি-বা টের পাওয়া যায়, ‘হৃদস্পন্দন’ টের পাওয়া যায় না। তিস্তা-অন্বেষা-দেবারতির বই তিনটি পড়লে আমরা সেই 'হৃদস্পন্দন'-এর সন্ধান পাব। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের আরও ভালো মানুষ ও ‘সচেতন নাগরিক’ হয়ে ওঠার সহায়ক হবে বইগুলি।।
স্বপ্লায়তন বইগুলি দৃষ্টিনন্দনও, আর তার কৃতিত্ব রঞ্জিত চিত্রকর ও সিরাজউদ্দৌলা চিত্রকর নামক দুই পটশিল্পীর। তাঁরা পটচিত্রের আদলে বই তিনটির ছবি এঁকেছেন ও অলঙ্করণ করেছেন। সিরিজটির প্রকাশক কলকাতার ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (আই-ডি-এস-কে) এবং রোজা লুক্সেমবুর্গ স্টিফটুং-এর সৌজন্যে ও আর্থিক সহায়তায় প্রকাশিত। ‘শিক্ষা জগতের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন সরকারি/ অসরকারি প্রতিষ্ঠান, নীতিনির্ধারক সংস্থা, সংবাদ মাধ্যম, শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং ছাত্রছাত্রীকে’ বিনামূল্যে বিতরণের সংকল্প ঘোষিত হয়েছে বইগুলির টাইটেল পেজ-এ। আশা করব, ছোটোরা তো বটেই, বড়োরাও বইগুলি সংগ্রহ করতে আগ্রহী হবেন।
………………………………………………………..
অন্বেষা সেনগুপ্ত, ইতিহাসে হাতেখড়ি: দেশভাগ (কলকাতা: আই ডি এস কে: ২০২২)
দেবারতি বাগচী, ইতিহাসে হাতেখড়ি: দেশের ভাষা (কলকাতা: আই ডি এস কে: ২০২২)
তিস্তা দাস, ইতিহাসে হাতেখড়ি: দেশের মানুষ (কলকাতা: আই ডি এস কে: ২০২২)