ওস্তাদ জাকির হুসেনের প্রয়াণে মন খারাপ গোটা বিশ্বের সঙ্গীতজগতের। যিনি কিনা তবলাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন এবং ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতকে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি এনে দিয়েছিলেন। যদিও ওস্তাদ হয়ে ওঠার বহু আগে শুরুর দিকে তাঁকেও কিছু কম স্ট্রাগল করতে হয়নি। এক সাক্ষাৎকারে নিজের জীবনের শুরুর বছরগুলিতে লড়াইয়ের কথা নিজেই শেয়ার করেছিলেন জাকির হুসেন। জানিয়েছিলেন, তিনি কীভাবে একবার বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার কথাও ভেবেছিলেন।
১৯৯৮ সালে সিমি গারেওয়ালকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অকপট জাকির হুসেন জানিয়েছিলেন, যে তাঁর মা বাবি বেগম তাঁর জন্য একটা ভিন্ন রাস্তা ভেবে রেখেছিলেন। যে রাস্তা ছিল তবলা থেকে বহু দূরে। জাকির হুসেনের কথায়, ‘আমাদের সময়ে, যখন আমরা খুব ছোট ছিলাম, তখনও সঙ্গীতকে এমন দারুণ কিছু ভাবা হত না, যে আপনি একটি শালীন জীবনযাপন করতে পারেন।’ তাঁর মা, একজন সঙ্গীতশিল্পীর জীবনের কষ্ট দেখে ছেলের একটা স্থিতিশীল ও সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ তৈরির অ্যাকাডেমিক পথই অনুসরণ করার কথা ভেবেছিলেন, এবিষয়ে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞও ছিলেন। জাকির হুসেনের কথায় ‘উনি (মা) সত্যিই এটা নিশ্চিত করার জন্য কঠোর পদক্ষেপ করেছিলেন যে আমি যেন মন দিয়ে পড়াশোনা করি এবং পড়াশোনাতেই মনোনিবেশ করি, এটা নিয়েই নিজের পায়ে দাঁড়াই। আমার ভবিষৎ সুরক্ষিত হোক।’
আরও পড়ুন-প্রয়াত জাকির হুসেন, এক নজরে ফিরে দেখা তাঁর জীবন
এরপরও জাকিরের গানের প্রতি ভালোবাসা বিন্দুমাত্র কমেনি। নিজের শৈশবের একটি মর্মস্পর্শী স্মৃতিতে ফিরে গিয়ে শিল্পী জানিয়েছিলেন, তিনি সঙ্গীতের শিক্ষাকেই বেশি প্রাধান্য দিতে চেয়েছিলেন, তবে নিজের মায়ের জেদে হতাশ হয়ে একবার বাড়ি পালানোর পরিকল্পনাও করে ফেলেছিলেন। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৬। তাঁদের বাড়িতে এক মহিলা কাজ করতেন, যাঁকে তিনি ভালবেসে পূজারান বলে সম্বোধন করতে।, তিনি জাকিরের এই পরিকল্পনায় তাঁর অসম্ভব আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। জাকিরের কথায়, তিনি তাকে বলেছিলাম, ‘তুমি গান গাও, আমি তবলা বাজিয়ে জীবিকা নির্বাহ করব। আমি আমার স্কুল ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছিলাম এবং যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম’। শেষপর্যন্ত যদিও তিনি বাড়ি ছাড়েননি। প্রসঙ্গত শিল্পী মাত্র ৩ বছর বয়স থেকেই তবলা বাজানো শুরু করেন, মাত্র ১১ বছর বয়সে প্রথম স্টেজে পারফর্ম করেন।
জাকিরের কথায়, ‘ আমার বাবাই ছিলেন আমার শিক্ষক’। জাকির স্বীকার করেছেন, তাঁর পরিবারের শিকড়ের সঙ্গেই শিল্পের গভীর বন্ধন ছিল।
জাকিরের কাছে সঙ্গীত শুধু প্যাশন ছিল না, ছিল একটা আহ্বান। তাঁর বিখ্যাত বাবা ওস্তাদ আল্লা রাখার ছায়ায় তিনি বেড়ে ওঠেছেন, যিনি কিনা এই তবলা কিংবদন্তিকে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে আলাপ করিয়েছিলেন। কিশোর বয়সেই, জাকির তার বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করতে আগ্রহী ছিলেন। তিনি তাঁর বাবাকে সম্বোধন করা চিঠিগুলি পড়ার কথা জানিয়েছেন। প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন, ‘উনি উপলব্ধিই করেননি যে তাঁর ছেলেও যথেষ্ট ভালো। তবে তারুণ্যের উচ্ছ্বাস মাঝে মাঝে তাঁর হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। হাসতে হাসতে জাকির বলেন, ‘অনেকবার, আমি ট্রেন ধরতে স্টেশনে পৌঁছে গিয়েছি এবং ওঁরা আমাকে পাশ কাটিয়ে গিয়েছে। ওঁরা আমার থেকে বয়সে বড় কাউকে প্রত্যাশা করেছিলেন। অথচ সেখানে আমি ছিলাম স্কুল শর্টস পরে’।
সঙ্গীতের প্রতি নিষ্ঠা থাকলেও আধুনিকতার মোহ থেকে দূরে ছিলেন না জাকির। তাঁর কথায়, ‘আমি জিন্স পরতে চেয়েছিলাম, আমি রক অ্যান্ড রোল তারকা হতে চেয়েছিলাম। আমি এক মিলিয়ন ডলার আয় করতে চেয়েছিলাম। আমি কাঁধে বুমবক্স নিয়ে বম্বের রাস্তায় ঘুরে বেড়াতাম, ডোরস এবং বিটলস শুনতাম। আমি ভেবেছিলাম এটাই উপায়, প্রচুর অর্থ উপার্জন করা এবং খুব দ্রুত বিখ্যাত হওয়ার’।
তবে এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী সঙ্গীতশিল্পী হিসাবে তাঁর জীবনের বাস্তবতা ছিল একেবারেই আলাদা। তাঁর কথায়, ‘আমি সেখানে গেলাম, তখন দেখলাম সেই জগৎ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমি সপ্তাহে ২৫ ডলার আয়েই বেঁচে ছিলাম, রোগ কোনও এক সবজির তরকারি পাত্র গরম করতাম আর সেটা রুটির সঙ্গে খেতাম। সেটা ছিল খুব কঠিন সময়।’ তিনি স্বীকার করে নেন যে তাঁর সেই যাত্রাপথ ঠিক সহজ ছিল না।
প্রথমত, এক সময় ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ছিল দ্বিতীয় শ্রেণির পেশা। আর সেই দ্বিতীয় শ্রেণির পেশায় তবলাবাদক ছিলেন সিঁড়ি একেবারে নিচে। মাঝে মাঝে অনেকেই জানতেও পারতেন না যে রেকর্ডের তবলা বাদক কে ছিলেন? তাঁর কথায়, 'আমি এমন সঙ্গীতশিল্পীদের সঙ্গে বাজাতাম যাঁরা হয়ত পরিচিতিও পাবে না এবং তবে নিশ্চিত ছিলাম যে আমি পরিচিতি পাব। তবে তারপরেও আমাকে হার মানতে হবে কারণ আমি শুধুই সঙ্গতে ছিলাম। তাই পারিশ্রমিকও ছিল কম। '