'কড়া ডায়েটের মধ্যে ছিলাম, প্রায় মাস দু'য়েক। সেসময় আমি শুধুমাত্র সেই খাবারই খেয়েছি, যেটা কাঁচা খাওয়া যায়। গ্ল্যামারকে মেরে আমায় এক্কেবারে শুকনো করতে হয়েছে। তখন আর কোনও চরিত্রে আমি কাজ করিনি। একটা চরিত্রের জন্য নিজেকে ভীষণভাবে তৈরি করতে হয় সব দিক দিয়ে। শুধু মেকআপ নয়, নিজের গঠনও বদলে ফেলি।
'বাল্মীকি' ও শ্রীকান্ত রায়ের ভূমিকায় প্রসেনজিৎ
পর্দার জন্য বারবারই নিজেকে ভেঙেছেন। ধরা দিয়েছেন বিভিন্ন চরিত্র, আবারও একবার একই সঙ্গে দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন চেহারার শিল্পীর ভূমিকায় ধরা দিলেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। কখনও তিনি রোগা পাতলা, উসকোখুসকো চেহারার 'বাল্মীকি', কখনও আবার তিনি 'গডফাদার' 'শ্রীকান্ত রায়'।
'জুবিলি'তে শ্রীকান্ত রায় একটা তারকা চরিত্র, বাস্তবে আপনি নিজেও একজন 'তারকা', রিলস আর রিয়েলে কোনও মিল পেয়েছেন?
প্রসেনজিৎ: শ্রীকান্ত রায় নিজে তারকা হওয়ার থেকেও উনি আসলে তারকা তৈরি করেন। একজন 'গডফাদার'-এর চরিত্র। সিনেমাটাই ওঁর প্যাশান, ভীষণই শক্তিশালী একটা চরিত্র, ৪০ ও ৫০-এর দশকে সিনেমার দুনিয়ার ওঁর একটা বিশাল অবদান রয়েছে। আর আমারও দীর্ঘ কেরিয়ারে আমি অনেক কিছু দেখেছি, অনেক বদল দেখেছি। প্রযুক্তিগত দিক থেকেও সিনেমার দুনিয়াকে বদলে যেতে দেখেছি। সেই সব অভিজ্ঞতাই আমায় এই চরিত্রটি করতে সাহায্য করেছে।
শ্রীকান্ত রায় 'গডফাদার', প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের জীবনও কি কোন 'গডফাদার' রয়েছেন?
প্রসেনজিৎ: দুর্ভাগ্যবশত, আমার জীবন, বা কেরিয়ারে আমি কোনও 'গডফাদার' পাইনি, আমি বলব, 'গডমাদার' পেয়েছি, আর তিনি আমার মা। আমার ভালো, মন্দ যা কিছুই সবটাই আমার মায়ের জন্য।
‘শ্রীকান্ত রায়’ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে ‘প্লে-ব্যাক সিংগিং’ থেকে শুরু করে অনেক নতুন কিছুর পরিচয় করিয়েছেন, যার জন্য উনি বিভিন্ন ঝামেলাতেও জড়িয়েছেন। সেবিষয়ের সঙ্গে নিজের দীর্ঘ কেরিয়ারে কোনও মিল খুঁজে পান?
প্রসেনজিৎ: এখানে আসলে একটা ইতিহাসকে তুলে ধরা হয়েছে, আর সবটাই সত্যি। আমিও আমার কেরিয়ারে গত ৪০ বছরে বিভিন্ন সময়ে অনেককিছুই বাংলা ছবিতে এনেছি, আর তা সবই ধাপে ধাপে। সেটা এখানে রিলেট করতে পেরেছি। আসলে যে কোনও ইন্ডাস্ট্রিতেই এমন কিছু মানুষ বা সঞ্চালকের দরকার হয়। সবাই মিলেই কাজ করেন।, তবে একজন কাউকে দরকার হয়, যিনি চালনা করেন। আমি যখন কাজ করি, প্রযোজকদের বলি, এটা কি করা যায়? বা ওটা একটা নতুন কিছু করা যেতে পারে। এটা আমি করেই থাকি। যদিও সব টিম ওয়ার্ক। তবে আমার নামটা বারবার আসে কারণ, আমি দীর্ঘ সময় ধরে ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করে চলেছি, বিভিন্ন পরিবর্তনে আমি সামিল হয়েছি, সেই সাদা-কালো ছবির সময় থেকে। তারপর বহু প্রযুক্তি এসেছে, সবেতেই আমি কাজ করেছি। আর এখন OTT-তেও রয়েছি। (হাসি)
'শ্রীকান্ত রায়'-এর ভূমিকায় প্রসেনজিৎ
'জুবিলি'তে অদিতি রায় হায়দারি ট্রেন থেকে নেমে যাবেন, ঠিক তখন শ্রীকান্ত রায় উঠছেন, তারপর তাকিয়ে থাকেন। কোনও ডায়ালগ নেই। ওই দৃশ্যটি কিন্তু ভীষণ প্রশংসিত হয়েছে…
প্রসেনজিৎ: হ্যাঁ, এটা প্রশংসিত হচ্ছে। এখানে 'সাইলেন্স' ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। এই প্রসঙ্গে আমি একটা কথা বলব, উৎসব (২০০০)-এ আমার একটা এমনই দৃশ্য ছিল। ঋতুদা (ঋতুপর্ণ ঘোষ) বলেছিলেন, ওয়ান শটে মুখটা ঋতু (ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত)র দিকে ঘোরাতে হবে। তাতেই বোঝাতে হবে আমি ভালো নেই, আমার ১০৪ জ্বর। কোনও সংলাপ ছিল না দৃশ্যটাতে। এই ধরনের চ্যালেঞ্জগুলো আমি ওঁর মতো পরিচালকদের কাছে শিখেছি বলেই হয়ত আজ এটা করতে পারছি।
আমি যাঁদের সঙ্গে কাজ করেছি, আমার পরিচালক, টেকনিশিয়ানস এবং আমার কাছে যাঁরা শ্রদ্ধেয় যেমন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, ছবি বিশ্বাস, ওঁদের থেকে যা শিখেছি, সেটাই আমি কাজে লাগাচ্ছি, তবে শিখেছি তো ওঁদের থেকেই। সেটা আমি মুম্বইতেও প্রসঙ্গক্রমে বারবার বলেছি।
এতবছর পর মুম্বইতে গিয়ে কাজ করতে গিয়ে কোনও কিছু চ্যালেঞ্জিং মনে হচ্ছে?
প্রসেনজিৎ: নাহ, সেভাবে কিছু নয়। আমি সবটাই ভীষণ উপভোগ করছি। এখন ওখানেও কোথায় গেলে আমায় এসে শ্রীকান্ত রয় বলে জড়িয়ে ধরছেন। হয়ত অনেককে চিনিও না। দু'দিন আগেই একজন এসে বললেন, ‘স্যার, নো বডি এলস কেন ডু শ্রীকান্ত রয়।’ এটা শুনতে বেশ ভালো লাগল। আমি এতবছর কাজ করেছি, এখন মুম্বইতে একেবারে নতুন টিমের সঙ্গে কাজ করছি, নতুন অভিনেতাদের সঙ্গে কাজ করছি, এমনকি সেটা কলকাতাতেও। আসলে যখন কাজ করি, আমার মধ্যে আমি এটা, আমি ওটা, এই বিষয়টা থাকে না। নাহলে 'শেষপাতা' করতে পারতাম না (হাসি)।
‘শেষপাতা’য় আপনি একেবারেই অন্যরকম, কোথায় 'শ্রীকান্ত রয়', আর কোথায় 'বাল্মিকী'! একদম 'নন গ্ল্যামারাস' একটা চরিত্র…
প্রসেনজিৎ: অথছ ‘বাল্মীকি’ও কিন্তু একজন শিল্পী। আসলে ‘বাল্মীকি’ চরিত্রটিকে ব্যাখ্য করা খুবই মুশকিল, খুবই বিরল একটা চরিত্র। এমন একটা চরিত্র ইতিহাস ঘাঁটলে, কিংবা কিছু ইন্টেলেকচুয়ালসদের থেকে পরিচালকদের কাছ থেকে হয়ত পেয়ে যাব। কিন্তু নির্দিষ্ট কোনও চরিত্রকে সামনে রেখে আমি এটার জন্য তৈরি হতে পারব এমন উদাহরণ আমার কাছে ছিল না। দুটো চরিত্র করতে গিয়ে আমাকে এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। যখন 'জাতিস্মর'-এ 'কুশল হাজরা'র চরিত্র করেছিলাম, তখনও আমার সামনে কোনও উদাহরণ ছিল না। ‘বাল্মীকি’ করার সময়ও তাই হয়েছিল। আমি তো প্রথমদিন অতনুকে বলেই দিয়েছিলাম, ‘আমি বোধহয় পারব না।’ কারণ, বাল্মীকি লোকটা ভীষণ 'আনপ্রেডিক্টটেবল'। এখানে একরকম, আবার এখান থেকে উঠে গিয়েই তার মন বদলে যায়। তবে এই চরিত্রগুলি ভীষণভাবেই বাঙালি চরিত্র। আজও ভারতবর্ষে আমরা বাঙালিরা যখন কথা বলি, বাংলার সাহিত্য, সিনেমা নিয়ে যখন কথা হয়, লোকজন কিন্তু একটা কথাই বলেন, ‘আপলোগ যো সোচতে হ্যায়, ও অলগ হ্যায়।’ আমাদের এটাই শক্তি, মারাঠিদেরও তাই। যাঁদের ইন্টেলেকচুয়ালিটি বেশি, তাঁদের কিছু নিজস্ব ইগো থাকে, নীতি থাকে। ‘বাল্মীকি’ এমনই একটা চরিত্র। এটার জন্য আমাকে এবং আমার পরিচালককেও ভীষণ খাটতে হয়েছে। এধরনের মানুষের শেষগুলো শেষটা খুব একটা সাধারণত মধুর হয় না।