শ্রেয়সী পাল বাংলায় কোনও চাকরি নেই। তাই এবার হাজারে হাজারে মানুষ ফিরতে চাইছেন নিজেদের কর্মভূমিতে। মুর্শিদাবাদে ফিটনেস সার্টিফিকেটের জন্য পড়েছে লম্বা লাইন। জেলার অধিকর্তারা জানিয়েছেন, তিন লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক যারা ফিরে এসেছেন, তাদের মধ্যে দশ হাজার জন ইতিমধ্যেই ফিটনেস সার্টিফিকেট নিয়েছেন স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলি থেকে। বাংলা থেকে যারা বাইরে কাজের খোঁজে বাইরে যান, তাদের একটা বড় অংশই মুর্শিদাবাদের নাগরিক।লকডাউন শিথিল হতেই প্রত্যেক দিন জেলার বিভিন্ন ব্লকে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির সামনে পড়ছে লম্বা লাইন। সবাই চান ফিটনেস সার্টিফিকেট যাতে যেখানে তারা লকডাউনের আগে কাজ করছিলেন, সেখানে ফেরা যায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলার এক বরিষ্ঠ স্বাস্থ্যকর্তা জানান যে সোমবার অবধি ১২৬ জন মুর্শিদাবাদে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। এর প্রায় ৯৫ শতাংশ হল পরিযায়ী শ্রমিক। তাঁরা না ফিরলে হয়তো গ্রামের মধ্যে দূর-দূরান্তে করোনা ছড়িয়ে পড়ত না বলেই সেই কর্তার অভিমত। এখন তাঁরা আবার ফেরত যেতে চাইছেন। এতে সংক্রমণ আরও ছড়াবে, বলে স্বাস্থ্যকর্তার আশঙ্কা কারণ অধিকাংশ করোনা রোগীই অ্যাসিম্পটোম্যাটিক, অর্থাত্ তাদের শরীরে কোনও চিহ্ন নেই। ভগবানগোলা-২ কম্যুনিটি ব্লক মেডিক্যাল অফিসার ডক্টর উত্পল মজুমদার জানিয়েছেন শয়ে শয়ে পরিযায়ী শ্রমিক নাশিপুর হাসপাতালে আসছেন নিজেদের ফিটনস সার্টিফিকেট নিতে, যাতে তারা ডিউটি জয়েন করতে পারেন। তিনি বলেন যে এসব শ্রমিকরা এতদিন হোম কোয়ারেন্টাইনে ছিলেন। যাদের শরীরে কোনও করোনার চিহ্ন নেই, তাদের সার্টিফিকেট দেওয়া হচ্ছে। যাদের শরীরে আছে সিম্পটম, তাদের টেস্ট করা হচ্ছে বলে জানান উত্পলবাবু। হিন্দুস্তান টাইমসের সঙ্গে যে সব পরিযায়ী শ্রমিকদের কথা হয়েছে, তারা জানিয়েছেন যে অনেক বেসরকারি সংস্থা রীতিমত যানবাহন পাঠাচ্ছে তাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সুতিতে ৬০ জন শ্রমিক বাস ভাড়া করে সোমবার ওড়িশায় গিয়েছেন। সামশেরগঞ্জের জাফিকুর ঠিকা মজদুরের কাজ করেন। তিনি জানান যে কেরালায় নির্মাণ ক্ষেত্রে তিনি যুক্ত ছিলেন। ওখানে ৮০০ টাকা রোজ মিলত। এখানে একই কাজের জন্য ২০০ টাকা দিতে চাইছে। তাই তিনি দ্রুত ফিরে যাবেন বলে জাানান জাফিকুর। প্রায় একই কথা বলছেন হাকিমপুর জেলার নৌসাদ আলম। সুরাতে গয়নার দোকানে কাজ করতেন তিনি। লকডাউনে ফিরে এসেছেন বাড়ি কাজ হারানোর পর। কিন্তু এখানেও কাজ নেই। তাই এক দুই দিনের মধ্যেই তিনি ফিরে যাবেন । এই নিয়ে অবশ্য শুরু হয়ে গিয়েছে রাজনীতি। বিজেপির রাজ্য নেতৃত্ব বলেছে যে মমতা পরিযায়ীদের ফেরত যাওয়া থেকে আটকাতে চাইছেন কারণ এখানে যে কোনও চাকরিবাকরি নেই, সেটা স্পষ্ট হয়ে যাবে। দলের জাতীয় সম্পাদক রাহুল সিনহা বলেন যে ভয় ও অর্থনৈতিক অনিশ্চিয়তা নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল পরিযায়ীরা। কিন্তু রাজ্য কোনও কাজের ব্যবস্থা করতে পারেনি, ভালো কোয়ারেন্টাইন পরিষেবাও দেয়নি, অভিযোগ বিজেপি নেতার। অনেকে মাঠে ঘাটে রাতে থেকেছেন বলেও দাবি তাঁর। একই সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের করোনা এক্সপ্রেস কটাক্ষের কথাও মনে করাতে ভোলেননি তিনি। তৃণমূলের অবশ্য দাবি, মহামারী এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে, তাই মানুষ ফিরে যাচ্ছে। জেলা পরিষদের সভাধিপতি তৃণমূলের মোশারেফ হোসেন বলেছেন যে প্রায় তিন লক্ষ মানুষ ফিরেছিলেন। অনেকে বিদেশ থেকেও এসেছেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে দেখে অনেকে তাঁদের কর্মভূমিতে ফিরে যাচ্ছে। এর জন্য অনেকে তাঁদের সাহায্যও নিয়েছে বলে জানান তিনি। প্রায় দশ হাজার মানুষ ইতিমধ্যেই ট্রেনে, বাসে ও গাড়ি করে ফিরতি পথে পাড়ি দিয়েছেন বলে জানান জেলা সভাধিপতি। বাংলায় যে বাইরের মতো ভালো টাকাপয়সা দেওয়া যাচ্ছে না, সেটা প্রায় স্বীকারই করে নিয়েছেন মোশারেফ হোসেন। পরিবারের কথা চিন্তা করে বাড়ি ফিরলেও এখন ফের কাজের জায়গায় উদ্দেশে তাঁরা ফিরছেন, বলে জানান মোশারেফ। অনেকের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করেছেন ভিন রাজ্যের মালিকপক্ষ বলেও জানান তিনি। রেশন দোকানের সামনে লাইন কমছে মানে মানুষ রোজগার করতে শুরু করেছেন বলে ব্যাখ্যা তৃণমূল জেলা সভাধিপতির। অতিরিক্ত জেলাশাসক সিরাজ ধ্যানেশ্বর জানান যে প্রশাসন মনরেগার আওতায় সবার জন্য ১০০ দিনের কাজের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছে। কিন্তু কেউ যদি তাদের পুরনো কর্মস্থলে ফিরে যেতে চান, প্রশাসন কী করবে, তাঁর প্রশ্ন। প্রেসিডেন্সির প্রাক্তন অধ্যক্ষ ও রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ অমল মুখোপাধ্যায়ের মতে,' মানুষ অন্য রাজ্যে তখনই যায় যখন কোনও কাজ পায় না বা ঠিকঠাক পয়সা পায় না কাজের জন্য। এবার যদি পরিযায়ীরা ফিরে যায়, তাহলে এটা বোঝা গেল যে মুখ্যমন্ত্রী যে উন্নয়ন হয়েছে বলে দাবি করেন, সেটা অনেকটাই বাহ্যিক ও আসলে তেমন কিছুই হয়নি। তৃণমূল আমলে কোনও শিল্প হয়নি রাজ্যে। বলতে খারাপ লাগছে, কিন্তু কর্মসংস্থানের সুযোগের মাপকাঠিতে বাংলা একেবারে পিছিয়ে'।ওড়িশার বোলাঙ্গির থেকে হিন্দুস্তান টাইমসের সঙ্গে কথা বলেছেন রহমান মিঞ্চা, যিনি সুতি থেকে ফিরে গেছেন ওই রাজ্যে কাজের খোঁজে। তিনি বলেন যে একটি কনস্ট্রাকশন সাইটে তিনি কাজ করেন। কোম্পানির দেওয়া বাসেই ১৬ এপ্রিল তারা বাড়ি ফিরেছিলেন। আবার তাদের বাসেই ফিরে গিয়েছেন তাঁরা। এইভাবেই যেমন ভাবে এসেছিলেন, তেমন ভাবেই ফিরছেন অনেকে।