‘যা সুন্দর, তাতে কিছু আঘাত থাকে। যে পায়, সে পায়। বাকিরা বুঝতেও পারেনা।’
কিছু কিছু কথা হয়ই এরকম৷ হঠাৎ করে চোখে পড়লে, কী যেন একটা হয়৷ কোথায় যেন লাগে৷
উপরের বাক্য দু'টি উদ্ধৃত করা হয়েছে অর্ঘ্য দীপের লেখা 'প্রত্যাখ্যানের আশ্চর্য দেবতা' বইটি থেকে৷ অর্ঘ্য দীপ পেশাগতভাবে একটি বহুজাতিক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কর্মরত৷ মনের তাগিদে লেখালেখি করেন৷ জীবনের নানান সূক্ষ্ম অনুভূতি, ঘাত-প্রতিঘাত, অন্তর্লীন একাকিত্ব তাঁকে ভাবিয়ে তোলে। অনুপ্রেরণা জোগায় নতুন শিল্পসৃষ্টির৷ এযাবৎকালে অর্ঘ্য দীপের লেখা বেশ কয়েকটি গান প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন মাধ্যমে৷ প্রকাশিত হয়েছে দু'টি বই - 'আলো হয়ে জ্বলে ওঠে শোক' এবং 'প্রত্যাখ্যানের আশ্চর্য দেবতা'।
'প্রত্যাখ্যানের আশ্চর্য দেবতা' বইটির নামের মধ্যেই আশ্চর্য শব্দটি রয়েছে৷ সত্যিই এ বড় আশ্চর্য এক বই৷ বইটি একাধারে কবিতা, অণুগল্প এবং বেশ কিছু মুক্তগদ্যের সংকলন। অনেকটা যেন কোনও এক আনমনা, বিষণ্ণ বালকের ব্যক্তিগত ডায়েরির ফর্মে লেখা৷ লেখাগুলো পড়তে পড়তে প্রশ্ন জাগে, কে এই প্রত্যাখ্যানের আশ্চর্য দেবতা? লেখকের নিজের কথায়, 'অনেক করে চাওয়ার পরেও যারা পায় না কিচ্ছুটি— তাদের তিনি পথ দেখান। এগিয়ে চলার পথ। অন্ধকারের দরজা পেরিয়ে, এক অনন্ত সাদা আলোর দিকে...'
মোট পাঁচটি আলাদা আলাদা অধ্যায়ে বইটিকে ভাগ করেছেন লেখক৷ 'এই যে যত প্রেমের লেখা', 'মায়া শুধু বেড়ে চলে', 'রহস্য থেকে যায় কিছু', 'শীতকাল এইভাবে আসে' এবং 'হলদে পাখির পালক' — প্রত্যেকটি অধ্যায়েরই রয়েছে নির্দিষ্ট থিম্যাটিক প্যাটার্ন৷ আবার কোথাও হয়তো প্রতিটি অধ্যায়ের মধ্যে একটা অদৃশ্য যোগসূত্রও বর্তমান৷ অধ্যায়ের পর অধ্যায় জুড়ে যেন ভেসে চলেছে অচিন এক মনকেমনের সুর, ঠিক যেন বিরহের সুরে বেজে ওঠা দূরের সানাই– যা একইসঙ্গে রিক্ত এবং পূর্ণ।

'এই যে যত প্রেমের লেখা' বইয়ের প্রথম অধ্যায়৷ এই অংশের কবিতা এবং মুক্তগদ্যে মিশে রয়েছে অবিনাশী প্রেম এবং শাশ্বত বিরহ৷ রয়েছে অনন্ত অপেক্ষা, রয়েছে চোখের জল, রয়েছে অবুঝ প্রার্থনা৷ রয়েছে সেই মেয়েটির কথা যে জ্যোৎস্না-ভরা রাতে পরী হয়ে যায়৷ পাঠকের মনে এক অদ্ভুত বিষাদসুন্দর আবেশ তৈরি করে এই অধ্যায়ের লেখাগুলো৷
'মায়া শুধু বেড়ে চলে' অধ্যায়ের প্রতিটি লেখাই এক আশ্চর্য মায়াপৃথিবীর কথা বলে৷ আত্মনিমগ্ন অলস দুপুরে যে ছেলেটি নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে, জানলার ওপার থেকে অজানা বাতাস এসে জানিয়ে যায় তার খবর৷ দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এলে, রূপকথাদেশে বেজে ওঠে রাখাল ছেলেটির বাঁশি৷ অলিগলিপথে অতীতবৃক্ষ থেকে ঝরে যায় ফুল। জলের স্রোতে হারায় কিশোরীর কানের দুল এবং অপেক্ষারত বালকের মায়াপ্রবণতা৷ নৈঃশব্দ্য ঈশ্বরীর ভাষা, এই কথা জেনে মেয়েটি থাকে নির্মোহ নিশ্চুপে৷ পাঠকের চোখ ভিজে আসে আখরের মায়াস্পর্শে৷
'রহস্য থেকে যায় কিছু' অধ্যায়টির অভিঘাত আবার সম্পূর্ণ অন্যরকম৷ খুন না আত্মহত্যা— এমন রহস্যের কিনারা করতে গিয়ে তদন্তকারী অফিসারটি মিলিয়ে যান বাতাসে৷ অন্যমনস্ক রেডিয়োয় ভারী মিষ্টি একটা সুর ফিরে ফিরে আসে৷ তাতে যদিও কথা থাকে না কোনও৷ দুঃখবিলাসী এবং অকালমৃত বালকের প্রবেশ নিষেধ যে স্বর্গের সিঁড়িতে, সেইখানে একলাটি বসে গান শোনে কেউ৷ দিনে দিনে ক্ষয়ে যাওয়া ইয়ারফোনের তারে, নাম না জানা একটা পাখি এসে বসে৷ শিশুটি দেয়ালার ঘোরে দ্যাখে, ডানা ঝাপটাচ্ছে আলোর পরীরা৷ কার যেন কবরে ফুটে ওঠে একটা দুটো ফুল৷ রহস্যময়তা ক্রমশ নিবিড় থেকে নিবিড়তর হয়৷

বইয়ের চতুর্থ অধ্যায় অর্থাৎ 'শীতকাল এইভাবে আসে' শীতকালীন অমোঘ নস্টালজিয়ায় ঘেরা৷ গাছের শুকনো পাতা, মাধ্যমিকের টেস্টপেপার এবং জ্বরের ওষুধ জানে কেমন ভাবে অতি ধীর পায়ে শীত আসে এই শহরে এবং কাউকে কিচ্ছুটি না বলে হঠাৎই একদিন চলে যায়৷ কোনও এক কুয়াশাচ্ছন্ন নভেম্বরের বিকেলে, মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে একটা রিকশা মিলিয়ে যায় গলির শেষ প্রান্ত ছাড়িয়ে আরও দূরে। সেই মেয়েটির বয়স আর বাড়ে না কোনওদিনই৷ নিঃসঙ্গ কোনও ক্রিসমাস গাছে অবিরত আলো জ্বলে, নিভে যায়৷ ফুল ফোটে না কখনও৷ তবুও তো কেউ কেউ আজও চিঠি লেখে৷ যে চিঠির কোনও উত্তর আসে না, শীতকালই হয়তো সেই চিঠি লেখার আদর্শ সময়৷
'হলদে পাখির পালক' এই বইটির শেষ অধ্যায়৷ লীলা মজুমদারের লেখা চিরকালীন উপন্যাসের নাম থেকে অধ্যায়টির নামকরণ করা৷ এই অধ্যায়টিতে রয়েছে বেশ কিছু মুক্তগদ্য৷ ফ্যান ফিকশনের আদলে লীলা মজুমদার, রবীন্দ্রনাথ কিংবা সুকুমার রায়ের একাধিক চরিত্রের দেখা হয়ে যায় এই অধ্যায়ে এসে৷ মায়াময় বাক্যের নির্মাণে তৈরি হয় এক অভূতপূর্ব অলীক জগৎ৷ 'কাফকা এবং হারিয়ে যাওয়া পুতুলের গল্প', 'শিউলি', 'বেমানান' এমন লেখাগুলোও আচ্ছন্ন করে পাঠককে৷ মনে হয়, সত্যি যে কোথায় শেষ হয় আর স্বপ্ন যে কোথায় শুরু হয়, সেকথা বলা সত্যিই মুশকিল৷
সবশেষে বইটির প্রচ্ছদ এবং অলংকরণ নিয়ে কিছু কথা বলা জরুরি৷ বইয়ের পাঁচটি অধ্যায় জুড়ে রয়েছে সৌরভ মিত্রর আঁকা অনেকগুলো ছবি৷ প্রতিটি ছবিই অদ্ভুত সুন্দর এবং গভীর বক্তব্য বহন করে৷ স্বর্ণাভ বেরার আঁকা প্রচ্ছদটিও বইয়ের মূল সুরের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায় অব্যর্থভাবে৷ ছবিতে আমরা দেখি, শেষ বিকেলের ফুরিয়ে আসা বিষণ্ণ মলিন এক আলোয় ছাদে এসে দাঁড়িয়ে আছে কেউ৷ তার দিকে নিষ্পলক চেয়ে আছেন প্রত্যাখ্যানের আশ্চর্য দেবতা৷
২০১৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত 'বাকিটা ব্যক্তিগত' সিনেমাটিতে একটি গান ছিল, 'সবার কিছু দুঃখ আছে, দুঃখ আছে ব্যক্তিগত/দুঃখ চাপার ভঙ্গি আছে, সবার আছে নিজের মতো... '। ঠিক সেভাবেই নিজের মতো করে যাঁরা দুঃখকে অনুভব করেন, অল্পতেই যাঁদের মায়া পড়ে, দু'চোখ জলে ভরে আসে যাঁদের, সেইসব পাঠক অবশ্যই বইটি পড়তে পারেন৷ হয়তো এই বইয়ের শব্দ এবং নৈঃশব্দ্যের মাঝে তাঁরা খুঁজে পাবেন নিজেদের মনের গোপন জাদু-আয়নাটিকে৷
বই : প্রত্যাখ্যানের আশ্চর্য দেবতা
লেখক : অর্ঘ্য দীপ
প্রকাশনা : বাহার