আজ সবার জন্যই এক অন্য রূপকথার মতো সুন্দর গল্প আনব। অনেকেই হয়তো জানেন না, আমাদের পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে কিছু মানুষ থাকেন, যাঁরা ভারতের ৭৫টি আদিমতম জনজাতির অন্যতম। কিন্তু একটা সময় পর্যন্ত তাঁরা সমাজের মূলস্রোত থেকে অনেকটাই পিছিয়ে ছিলেন। তখন সপ্তর্ষি বৈশ্য এবং তাঁর বন্ধুরা উদ্যোগ নেন, জামাকাপড়, খাবার দিয়েই দায়িত্ব ঝেড়ে না ফেলে তাঁদের স্বাবলম্বী করে তোলার। শুরু হয় এক অনন্য লড়াই।
পুরুলিয়ার বেড়সা গ্রামে এই জনজাতির বাস, যদিও আরও বেশ কয়েকটি গ্রামেও তাঁদের পাওয়া যায়। এঁরা মূলত অরণ্যচারী। জঙ্গলের কাঠ কেটে, তা বিক্রি করাই ছিল এঁদের মূল পেশা। সেখানে দাঁড়িয়ে আজ তাঁরা চাষ করতে শিখেছেন। শিখেছেন হাল চালাতে। নিজেদের অধিকার বুঝে নিতে। আজ আর সপ্তর্ষিদের ওঁদের হয়ে কথা বলতে হয় না। ওঁরা নিজেরাই পারেন সবটা।

নিজেদের জমি, যা একসময় অনুর্বর বলে পরিচিত ছিল, সেখানেই আজ ফলে আছে বেগুন থেকে ঢ্যাঁরস, লঙ্কা থেকে করোলা। হয় মাছ চাষ, গ্রামের মহিলারা বানাতে শিখেছেন অর্গ্যানিক আবির, আচার, ইত্যাদি। নিজেদের গোষ্ঠী তৈরি করেছেন। গ্রামের শিশুরা এখন নিয়মিত স্কুলে যায়। ক্যারাটে শেখে, শুধু শেখে না রীতিমত রাজ্য স্তরের পুরস্কার লাভ করেছে তারা। জুতো পরে, দাঁত মাজে। আগে একটা সময় এগুলোর কোনওটাই তারা করত না। তাঁরা কী করে এবারের স্বাধীনতা দিবস পালন করল জানেন? আসুন দেখে নিই।
বিরহড়দের স্বাধীনতা দিবস পালন
গ্রামের মহিলা গোষ্ঠীর নেত্রী, সারথি শিকারী পতাকা তোলেন। গাওয়া হয় জাতীয় সঙ্গীত। বিরহড়ি ভাষায় দেশাত্মবোধক গানও গায় খুদেরা। সব থেকে বড় কথা কী জানেন? তাঁরা এই কবছরে শিক্ষার গুরুত্ব বুঝেছেন। এই গ্রামের প্রথম ক্লাস এইট পাশ মঞ্জুর শিকারী নিজের একটা ঘর দান করে দিয়েছেন স্কুল বানানোর জন্য! হ্যাঁ, তবে শুধু সেখানে বিরহড় শিশুরাই পড়বে না, পড়বে আশপাশের গ্রামের সাঁওতাল শিশুরাও। যে মাস্টার মশাই তাঁদের এতদিন পড়াত, তিনিই পড়াবেন। এই গ্রামটার এখন একটা নিজের স্কুল হল। এভাবেই বিরহড়রা নিজেদের মতো অন্যরকম কিন্তু আন্তরিকতায় ভরা স্বাধীনতা দিবস পালন করলেন।
এই গ্রামের মাস্টারমশাই, বিধুভূষণ হাঁসদা বলেন, ‘দারুন উচ্ছ্বসিত। ওরা সবাই নিজেদের ভাষায় গান গেয়েছে আজ। স্বাধীনতার মানে বুঝতে শিখেছে।’ একই রকম মতামত রাখেন আদিবাসী সম্প্রদায়ের গবেষক জলধর কর্মকার। তিনি জানান, ‘যাঁদের কাছে রোজ দুবেলা দুমুঠো অন্ন জোগাড় করাই ছিল একটা লড়াই তাঁরাই আজ নিজেদের স্কুল বানালো। একটা সময় স্বাধীনতার মানে যাঁরা জানতো না, তাঁরাই আজ এভাবে দিনটা পালন করল। খুব গর্বিত অনুভব করছি।’
_1660556380964.jpeg)
আর যিনি গ্রামের জন্য নিজের ঘর দিলেন, সেই মঞ্জুর শিকারী কী বললেন? ‘আমার ঘরটা একটা ভালো কাজে লাগবে ভেবেই খুশি। আমি চাই ওরা সবাই অনেক দূর পড়ুক। আমরা খুব খুশি আজ।’
হ্যাঁ, আসলে খুশি হওয়ার জন্য অনেক কিছু লাগে না, অনেক কিছু জানতে হয় না। এভাবেই লাইমলাইটের বাইরে থেকে নিঃশব্দে কিছু করেও ভালো থাকা যায়। এক সময় যাঁদের (সিধো কানহো বিরসা) হাত ধরেই স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়েছিল আজ সেই তাঁরাই, ভারতের আদিম সন্তানরা নিজেদের মতো করে এক অন্য স্বাধীনতা দিবস পালন করল।