বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ (১৯৭১) ছিল বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা অর্জনের এক ঐতিহাসিক সংগ্রাম, যা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ৯ মাস ধরে চলেছিল। এটি ছিল একটি মুক্তিযুদ্ধ, যা বাঙালি জাতির অধিকার, মর্যাদা, এবং স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম চালিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ফলস্বরূপ, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে এবং পাকিস্তান থেকে পৃথক হয়ে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি ছিল দীর্ঘকালীন পাকিস্তানি শাসন ও বাঙালি জাতির বৈষম্য। ১৯৪৭ সালে ভারত থেকে পাকিস্তান পৃথক হয়ে দুই ভাগে বিভক্ত হলে পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ। তবে বাঙালিরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে একাধিক সমস্যা ও বৈষম্যের সম্মুখীন হচ্ছিল।
অসন্তোষের শুরু
পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চল থেকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ নানা ক্ষেত্রে বৈষম্য অনুভব করছিল। এসবের মধ্যে ছিল:
ভাষার আন্দোলন (১৯৫২): ১৯৫২ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বাঙালি ছাত্ররা আন্দোলন করলে পাকিস্তান সরকার তাদেরকে দমন করে এবং ঢাকা শহরে পুলিশের গুলিতে ভাষা শহীদ হন।
অর্থনৈতিক বৈষম্য: পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় অর্থনৈতিকভাবে উপেক্ষিত রাখা হয়েছিল, যদিও পূর্ব পাকিস্তান ছিল পাকিস্তানের সবচেয়ে উৎপাদনশীল অঞ্চল।
রাজনৈতিক অধিকার: পাকিস্তান সরকারের নীতির কারণে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তাদের রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, যা পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক দল ছিল, overwhelming সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। কিন্তু পাকিস্তান সরকার তাদের জয়কে মেনে নেয়নি এবং ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানায়।
মুক্তিযুদ্ধের সূত্রপাত
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী "অপারেশন সার্চলাইট" নামে একটি সামরিক অভিযান শুরু করে। ঢাকাসহ সারা দেশে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ, ধরপাকড় ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, যার ফলে বাঙালি জনগণ অতিষ্ট হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। এ ঘটনার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়।
মুক্তিযুদ্ধের প্রধান ধাপসমূহ
১. ২৫ মার্চ ১৯৭১ - পাকিস্তানি আক্রমণ
২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকায় ঢুকে অপারেশন সার্চলাইট শুরু করে। হাজার হাজার বাঙালিকে হত্যা এবং গ্রেফতার করা হয়, এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপরই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গেরিলা যুদ্ধ শুরু হয়।
২. মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় দেশের শহর ও গ্রামে, যেখানে সাধারণ মানুষ, ছাত্র, যুবক, নারীরা অস্ত্র হাতে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীন বাংলা বাহিনী গঠন করা হয় এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের সহযোগিতা দিতে এগিয়ে আসে। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে এক লাখেরও বেশি শরণার্থী ভারতে চলে যায়। ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশে ঢুকে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেয়।
৩. ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তা
ভারত ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। ৩ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে পণ্য ও সেনাশক্তি ব্যবহার করে ব্যাপক আক্রমণ শুরু করে।
৪. আত্মসমর্পণ এবং বিজয়
১৬ ডিসেম্বর, পাকিস্তান বাহিনী ঢাকায় আত্মসমর্পণ করে। পাকিস্তান সেনাপ্রধান লে. জেনারেল এ.এ. কে. নিয়াজী ভারতীয় সেনাপ্রধান লে. জেনারেল আক্রাম খান এবং বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেন। এর ফলে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে এবং বিশ্বের মানচিত্রে নতুন একটি দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের চিহ্ন
মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ নিহত হন এবং ২ লাখেরও বেশি নারী ধর্ষণের শিকার হন। এই অত্যাচারের শিকার মানুষের স্মৃতি ও সংগ্রাম বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূলে রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব
মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে জাতীয়তাবোধ এবং মুক্তির জন্য সংগ্রামের অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করেছে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণ রাজনৈতিক স্বাধীনতা, সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং নিজস্ব জাতীয় সত্ত্বার প্রতি আত্মবিশ্বাস অর্জন করে।
স্বাধীনতার পর
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস হিসেবে পালন করা হয় এবং প্রতি বছর এই দিনটি জাতি গঠনের এক মহামানবীয় মুহূর্ত হিসেবে উদযাপন করা হয়।
উপসংহার
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুধু একটি সামরিক সংঘর্ষ ছিল না, এটি ছিল একটি জাতির আত্মপরিচয় খোঁজার সংগ্রাম। এই যুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতি পৃথিবীর বুকে নিজেদের অবস্থান স্থির করে, তাদের অধিকার ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করে।