সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়
১৯৬৪ সালের অক্টোবর মাস, সকাল হয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ। দীর্ঘকালের গৃহসহায়ক রতন অনেক ডেকেও সারা পাচ্ছে না। বম্বের (এখন মুম্বাই) পেডার রোডের আর্ক রয়াল ফ্ল্যাটবাড়ি থেকে আকুল ফোন গেল পালিহিলের বাংলোয়। গীতা দত্তের নির্দেশে ঘরের দরজা ভেঙে রতন দেখল খাটে শুয়ে আছেন তিনি। মুখটা অল্প ফাঁক হয়ে আছে, চোখ দুটো আধবোঁজা, হাতটা তখনও তোলা। বলার বাকি ছিল অনেক কিছু। দশ তাঁরিখ যখন তিনি বিদায় নিলেন তখন তাঁর বয়স চল্লিশ বছর পূর্ণ হতে আরো নয় মাস বাকি। অভিনেতা, নৃত্যশিল্পী, প্রযোজক ও মাত্র আটটি ছবির পরিচালক গুরু দত্ত সেই দিন থেকে ইতিহাস বইয়ের সেই পাতায় ঠাঁই নিলেন, যেটি না পড়লে ভারতীয় সিনেমাকে জানা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। মৃত্যুর পর ছয়টি দশক কেটে গেলেও তাঁকে নিয়ে উৎসাহের ঘাটতি নেই। চলচ্চিত্র পরিচালকদের কাছে এক অত্যাশ্চার্য উদাহরণ। ব্যতিক্রমি কাল্ট পরিচালক মনিকাউল হোক বা ভারতীয় নবতরঙ্গের অন্যতম পুরোধা শ্যাম বেনেগাল অথবা বাণিজ্যসফল পরিচালক-প্রযোজক রাজ খোশলার মতো অজস্র পরিচালক, কলাকৌশলী, সংগীত পরিচালক ও নটনটীদের কাছে তিনি এক অসামান্য স্রষ্টা। এই সময়কালের অত্যন্ত সফল পরিচালক আর বালকি (চিনিকম ২০০৭; প্যাডম্যান ২০১৮ খ্যাত) সিরিয়াল কিলিং নিয়ে ‘চুপ; রিভেঞ্জ অফ দ্য আর্টিস্ট’(২০২২) করেন গুরু দত্তের উদ্ধৃত অনুষঙ্গে। যাঁর জীবন ও সিনেমা মিলেমিশে গিয়ে এক জীবন্ত মিথ-এ বিবর্তিত সেই গুরু দত্তের জন্মের এটি শতবর্ষ।
বসন্তকুমার শিবশংকর পাডুকোনের জন্ম ১৯২৫ সালের ৯ জুলাই কর্ণাটকের এক চিত্রপুর সারস্বত ব্রাহ্মণ পরিবারে। বাবা শিবশংকর স্কুলে পড়াতেন। কিছুদিন ব্যাংক ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন। পেশার জগতে ভদ্রলোক অসফল ছিলেন। মা বাসন্তীদেবীকে সংসারের হাল ধরতে হত। সুলেখিকা, অনুবাদক বাসন্তী শিক্ষকতা করতেন পরিবার প্রতিপালনে। একটি দুর্ঘটনার পর বসন্তকুমারের নাম বদলে করা হয় গুরু দত্ত। পাডুকোন পরিবার ১৯৩০ সালে কলকাতা চলেআসে। গুরু দত্ত ভর্তি হয়ে যান কলকাতাঁর হেয়ার স্কুলে। ভবানীপুর অঞ্চলে বসবাস আর কলকাতাঁর স্কুলের জগত গুরু দত্তের মনে বাংলা সংস্কৃতির এক স্থায়ী প্রভাব রেখে গিয়েছিল। কলকাতাতেই থাকতেন তাঁর এক সম্পর্কিত মামা বি.বি.বেনেগাল। কমার্শিয়াল আর্টিস্ট, চিত্রকর বেনেগালের ধর্মতলা স্ট্রিটের (লেনিনসরণী) বাড়িতে প্রায় গুরু দত্ত চলে আসতেন তাঁদের পদ্মপুকুর রোডের বাড়ি থেকে। পেশার সুযোগে ভাগ্নেকে সিনেমা দেখার পাস জোগাড় করে দিতেন বেনেগাল। সিনেমার প্রতি আকর্ষণ তাঁর কৈশোর থেকেই। বেনেগালের আঁকা একটা তৈলচিত্র ছিল তাঁর বাড়িতে। গলায় সাপ জড়িয়ে নৃত্যরত নটরাজ। একবার কলকাতাঁর কন্নড় সারস্বত সমাজের অনুষ্ঠানে সেই ভাবনায় নৃত্য পরিবেশন করে খুব বাহবা পেলেন গুরু। পরে যখন উদয়শঙ্করের আলমোড়ার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির আবেদন করলেন, তখন স্বয়ং উদয়শংকর তাঁর অডিশন নেন। সেখানেও ওই নাচেই মুগ্ধ করলেন নৃত্যগুরুকে। আলমোড়ায় শিক্ষার্থী হওয়ার আর্থিক দায়ভার বাসন্তী-শিবশঙ্করের পরিবার বহন করতে পারতো না। উদয়শঙ্করের উদ্যোগেই জুটে যায় স্কলারশিপ। ১৯৪২ সাল থেকে দুই বছর আলমোড়ায় থাকার সময় তাঁর শিল্পভাবনা বিশেষভাবে পরিশীলিত হল। উদয়শঙ্করের প্রতিষ্ঠানে শুধু নাচ শেখানো হত না। প্রতি সন্ধ্যায় শিল্প ও সাহিত্য-সংস্কৃতির বিশেষজ্ঞরা নানা বিষয়ে ক্লাস নিতেন। যা ছাত্রছাত্রীদের সামগ্রিক নান্দনিক বিকাশের সহায়ক ছিল। আলমোড়া থেকে কলকাতায় ফিরে তখনই কর্মসংস্থান ভীষণ জরুরি হয়ে পড়ে। কলকাতাঁর লিভার ব্রাদার্স-এ টেলিফোন অপারেটরের চাকরি করেন কিছুদিন। এরপর শিবশঙ্কর-বাসন্তী বোম্বেতে গিয়ে সংসার পাতেন। গুরু দত্ত পরিবারের সঙ্গে যান। একদিন কাজের সন্ধানে পুনার প্রভাত স্টুডিওতে হাজির হন। এখানেই পরিচয় দেব আনন্দ এবং রহমানের সঙ্গে। এই ত্রয়ীর বন্ধুত্ব আমৃত্যু বজায় ছিল। প্রভাত স্টুডিওয় পরিচালক বাবুরাম পাই-এর কাছেও নিয়ে গিয়েছিলেন মামা বি বি বেনেগাল। তাঁকে প্রভাত স্টুডিও নিয়োগ করেছিল কোরিওগ্রাফার হিসেবে। পাশাপাশি সহকারী পরিচালকের কাজও করতে হত। এখানে অভিনয়ও করতে হল সুদর্শন গুরু দত্তকে। প্রথমদিকের অভিনীত ছবিগুলোর মধ্যে ডি ডি কাশ্যপ পরিচালিত ‘চাঁদ’ (১৯৪৪), বিশ্রাম বেদকারের ‘লাখরানী’ (১৯৪৫), প্রভৃতি ছবিতে তাঁর অভিনয় প্রশংসিত হল। দু’বছর প্রভাতে কাটিয়ে বোম্বে চলে এলেন। আদিনাথ ব্যানার্জীর ‘মোহন’ (১৯৪৭)-এ সহকারী পরিচালকের কাজ পেলেন। আবার কিছুদিন বেকার। ভাই আত্মারামের সঙ্গে যৌথভাবে বইয়ের ব্যবসাও করলেন। এই সময়ই ‘পিয়াসা’র গল্প লেখা শুরু। যদিও প্রথম অবস্থায় এর নামকরণ করেছিলেন ‘কসমাকাস’। ১৯৪৯ সালে ‘গার্লস স্কুল’ ছবিতে অমিয় চক্রবর্তীর সহকারী হয়ে বম্বেতে তাঁর অবস্থান পোক্ত হল। ১৯৫০ সালে এলেন বম্বে টকিজে। সুযোগ হল জ্ঞান মুখার্জির অধীনে কাজ করার। গুরু দত্ত ‘সংগ্রাম’ (১৯৫০) ছবির সহকারী পরিচালক হলেন। এই ছবিতে জ্ঞান মুখার্জি ভারতীয় পর্দায় প্রথম অ্যান্টিহিরোর ধারণা সুপ্রতিষ্ঠিত করলেন, যা গুরু দত্তকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। কার্যত জ্ঞান মুখার্জিকে গুরু মানতেন গুরু দত্ত। গুরু দত্ত তাঁর ‘পিয়াসা’ (১৯৫৭) জ্ঞান মুখার্জির স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিবেদন করেন। অনেক সমালোচক মনে করেন জ্ঞান মুখার্জির জীবনের ছায়া ‘কাগজ কে ফুল’ (১৯৪৯) ছবির আখ্যানকে প্রভাবিত করেছে। অবশ্য এই ছবিতে হলিউড ব্লকব্লাস্টার ‘এ স্টার ইস বর্ন’ (১৯৫৪)-এর প্রভাবও আছে।
প্রভাত স্টুডিওর শিক্ষানবিশির দিনগুলিতে দুই বন্ধু দেব আনন্দ ও গুরু দত্ত প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, যদি দেব কখনও ছবি প্রযোজনা করেন তবে গুরু দত্ত হবেন তাঁর পরিচালক। আর যদি গুরু পরিচালক হন, তবে নায়ক হবেন দেব আনন্দ। দুই বন্ধু তাঁদের কথা রাখতে পেরেছিল। দেব সাহেবের পারিবারিক সংস্থা নব কেতন ফিল্মস যখন 'বাজি' (১৯৫১) করবে ঠিক করল, তখন প্রথমবারের জন্য চলচ্চিত্র পরিচালনার সুযোগ পেলেন গুরু দত্ত আর নায়ক রূপে তিনি বেছে নিলেন দেবসাহেবকে। চিরাচরিত ভারতীয় ছবির নায়কের নীতিবান সৎ চরিত্র নির্মল স্বভাবের নায়কের পরিবর্তে গুরুর নায়ক হলেন আলো আঁধারে মেশানো এক চরিত্র। সমাজের অপছন্দের জগতে তাঁর অনায়াস যাতায়াত। আমেরিকার ফিল্ম নোয়া ঘরানা সুস্পষ্ট প্রভাব ফেলল ‘বাজি’তে। কেবল আখ্যানে নয় ছবির নির্মাণরীতিতেও। ছবির মতোই দুর্দান্ত সফল হল ছবির গানগুলি। গুরু দত্তের দৃশ্যায়নের বৈশিষ্ট্যগুলি এই ছবি থেকেই দেখা যেতে লাগল আর গানের দৃশ্যায়নে তাঁর অভিনবত্ব দেখা গেল ‘বাজি’তে। পরের ছবি 'জাল' (১৯৫২)। সেই অপরাধ, বিশ্বাসভঙ্গ, ভালোবাসার টানা পোড়েনের আখ্যান। এই ছবিতে দেবসাহেবের বিপরীতে গীতাবালি। এবারও শচীনদেব বর্মনের সুরে বাজিমাত করল ছবির গানগুলি। অবশ্যই সঙ্গীত চিত্রায়নের অভিনবত্ব দর্শক-সমালোচকদের দৃষ্টি এড়াল না। তৃতীয় ছবি 'সি.আই.ডি' (১৯৫৬) কাহিনিতেও অপরাধ জগৎ। এখানে দেবসাহেবের বিপরীতে শাকিলা, কিন্তু এই তুমুল হিট ছবিতে কয়েকটি বড় পরিবর্তন এল। প্রথমত গুরু দত্ত প্রযোজনায় এলেন। ছবির প্রযোজনা সংস্থা গুরু দত্ত মুভিজ প্রাইভেট লিমিটেডের অংশীদারিত্ব ছিল গুরু দত্ত, গুরুস্বামী এবং আত্মারামের। এই ছবিতে শচীনকর্তার জায়গায় সুর করতে এলেন ও.পি. নায়ার। এই ছবিতে প্রধান নারী চরিত্রে গুরু দত্ত হাজির করলেন ওয়াহিদা রহমানকে। এই ঘটনা ভারতীয় সিনেমার ক্ষেত্রে যতটা গুরুত্বপূর্ণ, হয়তো গুরু দত্তের জীবনের ক্ষেত্রেও ততটাই। পরের ছবি 'বাজ' (১৯৫৩) ষোড়শ শতাব্দীতে মালাবার উপকূলের এক দেশীয় রাজ্যের সঙ্গে পর্তুগিজ বণিকদের সংঘাতের কাহিনি। প্রচুর অ্যাকশন দৃশ্য সম্বলিত ছবি। এই ছবিতেই প্রথমবারের জন্য নিজের ছবির নায়ক হলেন গুরু দত্ত নিজেই। এ ছবির সাফল্যের রেশ মিটতে না মিটতেই মধুবালার সঙ্গে জুটি বেঁধে করলেন 'মিস্টার এন্ড মিসেস ফিফটিফাইভ' (১৯৫৫)। নায়ক প্রীতম একজন কার্টুনিস্ট। যার আঁকা কার্টুন চিত্রগুলি বাস্তবসম্মত করতে সেগুলি আঁকানো হল প্রখ্যাত কার্টুনিস্ট আর কে লক্ষণকে দিয়ে। গুরু দত্তের কাল্ট মুভি 'পিয়াসা' (১৯৫৭) মুক্তির আগের বছরেই মুকুল রায়ের প্রযোজনায় 'সৈলাব' ( ১৯৫৬) পরিচালনা করেন গুরু দত্ত। তাঁর প্রভাত স্টুডিওর বন্ধু রামসিং এই ছবির নায়ক। যদিও ‘পিয়াসা’ ছবির প্রস্তুতি তিনি দীর্ঘদিন ধরে নিয়েছিলেন। 'পিয়াসা' তাঁকে এক অসীম উচ্চতায় পৌঁছে দেয়। কবি বিজয় (গুরু দত্ত) সমাজ-সংসার, আত্মীয়-পরিজন, প্রেমিকা সকলের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়। দারিদ্র আর বঞ্চনা ছাড়া তাঁর প্রাপ্তির খাতা শূন্যই থাকে। তাঁর কবিতা প্রকাশে গররাজি সকল প্রকাশক। অথচ তাঁর মৃত্যুর খবর জেনে তাঁর রচনা প্রকাশ করে মুনাফা লোটে প্রকাশক ও তাঁর পরিবার। তাঁর প্রবঞ্চিত জীবনে তাঁর পাশে থাকে কেবল তাঁর বন্ধু এক মালিশওয়ালা (জনিওয়াকার) আর বারবনিতা গুলাবু (ওয়াহিদা রহমান)। এই ছবিতে পরিচালক সরাসরি সমাজব্যবস্থাকেই কাঠগড়ায় তোলেন। ‘পিয়াসা’ সাধারণ দর্শক থেকে প্রাজ্ঞ সমালোচক সকলকে মুগ্ধ করেছিল। ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এটি একটি অত্যুজ্জ্বল মাইল ফলক। গুরু দত্তের পরিচালিত শেষ ছবি 'কাগজ কে ফুল' (১৯৫৯)। কেবল ভারতে নয়, আন্তর্জাতিক সিনেমার নিরিখেও একটি অসামান্য সংযোজন। চলচ্চিত্র পরিচালক সুরেশ সিনহার শিল্পীজীবন ও ব্যক্তি জীবনের অবিশ্রান্ত দ্বন্দ্ব এই ছবির আখ্যানের মূল অংশ। সুরেশের সাংসারিক জীবন সুখের নয়। স্ত্রীর থেকে বিচ্ছিন্ন সুরেশের জীবনের নোঙর তাঁর কন্যা। অন্যদিকে নবাগত শান্তি (ওয়াহিদা রহমান)-কে নিজের মেধা ও পরিশ্রমে দেশের সেরা তারকা অভিনেত্রী রূপে গড়ে তোলেন। নিজের অজান্তেই তাঁরা পরস্পরের মনের কাছাকাছি চলে আসেন। যে সম্পর্ক মানতেও নারাজ সুরেশের কন্যা। এই বিয়োগাত্মক আখ্যানের মহাকাব্যিক নির্মাণ সম্ভবত হিন্দি ছবির সর্বভারতীয় বাজারের কাছে সময়ের চেয়ে অনেকটাই এগিয়েছিল। গুরু দত্তের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি তাঁর ফ্লপতম ছবি। ওই ছবির জন্য গুরু দত্ত ফিল্মস এর আর্থিক ক্ষতি হয়েছিল সাত কোটি টাকা। হতাশ গুরু দত্ত এরপর চলচ্চিত্র পরিচালনার দায়িত্ব ছেড়ে দেন। তাঁর প্রোডাকশন এরপর মহম্মদ শাহিদের পরিচালনায় 'চৌধবী কা চাঁদ (১৯৬০), আবরার আলাভি’র পরিচালনায় 'সাহেব বিবি আউর গোলাম'(১৯৬২)-এর মতো ছবি করে। দুটি ছবিরই কেন্দ্রীয় চরিত্রে গুরু দত্ত অভিনয় করেন। দুটি ছবি বাণিজ্য সফল। পরিচালনার দায়িত্বে না থাকলেও এই ছবিগুলিতে তাঁর শিল্পভাবনা, তাঁর ঘরানার ছাপ স্পষ্ট। ‘সাহেব বিবি গোলাম’ সে বছর সেরা হিন্দি ছবিরূপে জাতীয় পুরস্কার পায়। বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাস্যোসিয়েসন (বি এফ জে) গুরু দত্তকে সেরা অভিনেতাঁর পুরস্কার দেয়। তাঁর শেষবার পর্দায় আসা ঋষিকেশ মুখার্জির 'সাজ আউর সাবেরা’ (১৯৬৪) ছবিতে।
গীতা রায়চৌধুরী বোম্বের অন্যতম সেরা প্লেব্যাক সিঙ্গার। ‘বাজি’ ছবির গানের রেকর্ডিং-এর সূত্রে গুরু দত্তের সঙ্গে আলাপ। দুজনের মধ্যে অল্পদিনের মধ্যেই মন দেওয়া-নেওয়া সারা হয়ে গেল। গীতা তখন খ্যাতির চূড়ায়, গুরু দত্ত তখন নেহাতই স্ট্রাগলার। এই সম্পর্কে গীতার বাড়ির লোকের ঘোরতর আপত্তি ছিল। গীতার জেদের কাছে পরিবারকে হার মানতে হয়। সম্পূর্ণ বাঙালি রীতি রেওয়াজ মেনে গায়ে হলুদ থেকে ফুলশয্যার অনুষ্ঠান পালিত হয়। গীতার পরিবার বিয়েতে যে জাঁকজমক করে, তা দেখে গুরুর ভাইবোনেরা অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। বিয়ের পর নানা কানাঘুষো শুরু হয়। অনেকেই আড়ালে আবডালে বলতে থাকে গুরু বিয়ে করেছে গীতার টাকা দেখে। গুরু দত্তের পরিবার সত্যিই আর্থিকভাবে পশ্চাৎপদ ছিল। গুরু দত্তের বোম্বের বাড়িতে নাকি প্রথম সিলিং ফ্যান কেনা হয় ‘বাজি’ ছবির সাফল্যের পর। গীতা রায়চৌধুরী থেকে গীতা দত্ত হওয়ার পর পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন ঘটে। পরিচালক অভিনেতা প্রযোজকরূপে গুরু দত্ত সাফল্যের চূড়ায় ওঠেন। খ্যাতি অর্থ সব কিছু আসতে থাকে বন্যার মত। গুরু দত্তের বোন চিত্রকর ললিতা লছমি, (যার মেয়ে চিত্রপরিচালক কল্পনা লছমি) বলেছেন গীতা গুরুকে খুব ভালোবাসতেন আর প্রচণ্ড পজেসিভ ছিলেন। গুরুর শুটিং-এর সময় গিয়ে ফ্লোরে বসে গুরুর ওপর নজরদারি করতেন। কিন্তু গুরু দত্ত কি কম পজেসিভ ছিলেন? তিনি চাইতেন না গীতা তাঁর ছবি ছাড়া অন্যত্র গান করুন। এইসব টানাপোড়েনে গীতার কেরিয়ার খুব ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গীতা ও গুরু দত্তের দুই ছেলে তরুণ ও অরুণ এবং এক মেয়ে নীনা। ওয়াহিদা রহমানের আগমন তাঁদের সম্পর্ককে আরও জটিল করে তোলে। তেলেগু ছবির নবাগত নায়িকা ওয়াহিদাকে গুরু দত্ত ঘষে মেজে দেশের অন্যতম সেরা তারকায় পরিণত করেন। গ্রিকপুরাণের পিগম্যালিয়নের মত গুরু দত্ত নিজের সৃষ্টির প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন কি না জানা নেই। তবে তাঁদের সম্পর্ক নিয়ে দেশজুড়ে গসিপের বন্যা বইত। আবার ওয়াহিদা ও গুরু দত্তের সম্পর্কের মধ্যে ধর্মীয় ভিন্নতা ছিল বড় অন্তরায়। গীতাকে খুশি করতে গুরু দত্ত তাঁকে নায়িকা করে গৌরী নামে একটি ছবির শুটিং শুরু করেন ১৯৫৭ সালে। যদিও স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ায় সেই ছবি অসমাপ্তই থেকে যায়। তাঁদের পারস্পরিক বিবাদের জেরে পালিহিলের বাড়ি ছেড়ে গুরু দত্ত পেডার রোডে আলাদা থাকা শুরু করেন। মৃত্যুর আগের রাতে তাঁর অতি ঘনিষ্ঠ লেখক-পরিচালক আবরার আলভির সঙ্গে পরের প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা করেন। মৃতদেহ আবিষ্কারের পর প্রথম সেখানে পৌঁছান দেব আনন্দ। তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী তিনি গ্লাসে একটি গোলাপী পানীয় দেখতে পান। গ্লাসটি গুরু দত্তের ঘরের বেডসাইড টেবিলে ছিল। পোস্টমটেমে মৃত্যুর কারণ বলা হয় মদের সঙ্গে অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ মেশানোকে। বোন ললিতা মনে করেন এটি আত্মহত্যা। এর আগেও গুরু দত্ত দুবার আত্মহননের চেষ্টা করেছিলেন। ‘সাহেব বিবি গোলাম’ ছবির সময় ঘুমের ওষুধ বেশি খেয়ে ফেলায় তিনি তিনদিন কোমায় ছিলেন। জ্ঞান ফিরতে প্রথম যে শব্দটি উচ্চারণ করেন সেটি ‘গীতা’। পুত্র তরুণ মনে করেন বাবার আত্মহত্যার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। নেশা বাড়াতে অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ মদে মিশিয়ে ফেলাই কাল হয়েছিল। গুরু দত্তের মৃত্যুর পর বলিউড সহজে নিজের ছন্দে ফিরেছিল। কিন্তু ফিরতে পারেননি গীতা। গুরু দত্তের অকাল প্রয়াণে জীবনের প্রতি সব আসক্তি হারিয়ে ফেলে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ১৯৭২ সালে মাত্র বিয়াল্লিশ বছর বয়সে গীতা দত্ত প্রয়াত হন।
গুরু দত্তের পরিচালনানৈপুণ্য নিয়ে উচ্ছ্বসিত তাঁর অনুজ পরিচালকরা। মনি কাউল মুগ্ধ তাঁর লেন্স ব্যবহারের সুষমায়; আলোকসম্পাতের মায়াবী শৈলীতে। গুরু দত্ত হলিউড ছবির শৈলীতে মুগ্ধ ছিলেন। হলিউড মেলোড্রামা ও মিউজিক্যাল-এর ক্লাসিকগুলি তাঁকে প্রভাবিত করত একই সঙ্গে প্রথাবিমুখ পথে চলার উৎসাহ তাঁর ছিল। গুরু দত্ত টিমের প্রধান এক স্তম্ভ চিত্রগ্রাহক ভি কে মূর্তি, গুরুর প্রথম ছবি ‘বাজি’র সহকারী ক্যামেরাম্যান ছিলেন। তিনি ‘বাজি’ ছবিতে গানের দৃশ্যে প্রথমে আয়নায় দেব আনন্দকে ফ্রেমে ধরেন। তাঁরপর ওই একই শটে ক্যামেরা প্যান করে এবং পরে ট্র্যাকিং করে দেব আনন্দকে অনুসরণ করে। দেব আনন্দন হেঁটে গিয়ে একটা জায়গায় বসলে শটটি শেষ হয়। এই শটটি ছবির ক্যামেরাম্যান ভি রতম নিজে নেননি, নিয়েছিলেন তাঁর সহকারী মূর্তি। পরের ছবি থেকে গুরু দত্ত’র ‘ডিওপি’ হয়ে গেলেন মূর্তি। তাঁরা দুজনে নানা পরীক্ষা চালান। বিশেষত ক্লোজআপের বৈচিত্র্যময় ব্যবহারে গুরু দত্ত খুব আগ্রহী ছিলেন। অনেক সময় কোন সিকুয়েন্সের সূচনায় প্রথা ভেঙে আগে ক্লোজআপ ব্যবহার করে পরে এস্টাবলিশিং শট ব্যবহার করতেন। ‘কাগজ কে ফুল’ ছবির ‘ওয়াক্ত নে কিয়া’ গানে দর্পনে প্রতিফলিত আলোকসম্পাত বা পিয়াসায় প্রকাশকের দপ্তরের মালা সিনহার পুরো প্রবেশপর্বটি একটি মাত্র শটে দৃশ্যায়িত করার মতো নানা বৈচিত্র্যময় দৃশ্যায়ন ভারতীয় সিনেমাকে সমৃদ্ধ করেছে। তিনি প্রথম ভারতে সিনেমাস্কোপ ব্যবহার করেন ‘কাগজ কে ফুল’ ছবিতে। রঙিন ছবির কাজ যথাযথ বুঝতে তিনি মূর্তিকে পাঠান হলিউডে। ভি কে মূর্তি হলিউড ব্লকবাস্টার ‘গানস্ অফ নেভারুন’ ছবিতে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। শ্যাম বেনেগাল মনে করেন, ভারতীয় সিনেমায় গুরু দত্তের মৌলিক অবদান গানের দৃশ্যায়ন। গুরু দত্তের ছবিতে গান কেবল কোনও আইটেম বা সিকোয়েন্স নয়, আখ্যানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কখনও গান সংলাপের চেয়েও তীক্ষ্ণভাবে বক্তব্য হাজির করতে পারে। সাধারণ ভাবে ভারতীয় সিনেমায় গান বাস্তবতার মায়াকে ভেঙে দেয়। কিন্তু গুরু দত্ত চাইতেন গান আসুক বাস্তবধর্মী পথে। যেমন ‘মিস্টার এন্ড মিসেস ফিফটি ফাইভ’ ছবিতে সংলাপ থেকে কোনও প্রিলিউড মিউজিক ছাড়াই হঠাৎ শুরু হওয়া ‘দিল মে হুয়া আইসা জাদু’ গানটি, যেন সংলাপের সম্প্রসারিত অংশ। আবার পিয়াসাতে প্রিলিউড মিউজিক শেষে ‘হাম আপকি আখোঁমে...’ গানটি আসে কারণ এই গান নায়কের দিবাস্বপ্ন। বাস্তবে ঘটছে না। ‘বাজি’র চিত্রনাট্যকার বলরাজ সাহানি বিরক্ত হয়েছিলেন গুরু দত্তের উপর। কারণ তাঁর মনে হয়েছিল পরিচালক গল্পের চেয়ে গানকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে কতকটা শশধর মুখার্জির ঘরানায়। কিন্তু গুরু দত্ত ভারতীয় সিনেমার গানকে নতুন পথ দেখিয়েছিলেন। তিনি সংগীত পরিচালনায় সংগীত পরিচালকদের সঙ্গে নিয়ে নানা পরীক্ষায় অভ্যস্ত ছিলেন। ‘পিয়াসা’ ছবিতে শচীন দেববর্মনকে দিয়ে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের জন্য আলাদা আলাদা আবহ সংগীত প্রস্তুত করিয়েছিলেন। এই ছবির ‘এ দুনিয়া অগর মিল যায়ে’ গানটি কার্যত সায়র লুধিয়ানভির একটি প্রকাশিত কবিতা ‘চাকোলে’(অর্থঃ পতিতাপল্লী)। কবি তাঁর ভারতীয় গণনাট্য সংঘের অভিজ্ঞতা ও আদর্শের নিরিখে লেখেন, যেখানে ব্যক্তি জীবনের রোমান্টিক দ্যোতনা আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক প্রসঙ্গে অনুষঙ্গে মিশে যায়। পরিচালক সেভাবেই কবিতাটির গীতিরূপ ব্যবহার করেন। পাশ্চাত্য সংগীতের খুব গুণগ্রাহী ছিলেন গুরু দত্ত। নিজের ছবির সংগীত পরিচালকদের অনুরোধ করতেন তাঁর ছবির গানে পাশ্চাত্যের সুরের প্রয়োগের। এভাবেই ব্রিং ক্রসবি’র ‘Sing Sing Sing a Song with Me’ ভেঙে ছবিতে এল ‘শুন শুন শুন শুন বালমা’, মেক্সিকান কুইজিন্স থেকে এল ‘বাবুজি ধীরে চলনা’-এর মত গান।
গুরু দত্তের ছবি তাঁর আত্মজৈবনিক উপাদানে ভরপুর। ভাই বিজয় জানান কলকাতায় এক ধনী শিখ গ্যারেজ মালিকের মেয়ের সঙ্গে গুরু দত্ত প্রেম করতেন। গুরু দত্তর পরিবারের তৎকালীন ‘স্ট্যাটাস’–এর কারণে মেয়ের বাবার এই সম্পর্কে ঘোরতর আপত্তি ছিল। এই ঘটনা হুবহু চলে আসে ‘আরপার’(১৯৫৪) ছবিতে। বিজয়ের কথাতেই জানা যায় খাবার টেবিলে বাবা-মায়ের ঝগড়া একটা নিত্যনৈমিতিক ঘটনা ছিল আর ঝগড়া শুরু হলেই গুরু তাঁর সিগারেটের প্যাকেটটা নিয়ে বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে যেত। এই ঘটনার চিত্রায়ন ও ‘আরপার’ বা ‘পিয়াসা’ ছবিতে ভিন্নভাবে এসেছে। আর ‘কাগজ কে ফুল’ ও তাঁর জীবনবৃত্তান্তের মিলেমিশে যাওয়া তো বহুচর্চিত।
গুরু দত্ত’র তিনটি ছবিতে তাঁর শিল্পীসত্তার সংগ্রামের কথা প্রত্যক্ষত আসে ‘মিস্টার এন্ড মিসেস ৫৫’-এ কার্টুনিস্ট প্রীতম, ‘পিয়াসা’র কবি বিজয় এবং ‘কাগজ কে ফুল-এর চিত্র-পরিচালক সুরেশ সিনহা কার্যত গুরু দত্তের চরিত্রের সম্প্রসারিত অংশ। আমাদের সমাজ-সংসারে অর্থ, কীর্তি, সচ্ছলতার বাঁধা মাপকাঠিতে সফল ও ব্যর্থ মানুষের যে সংজ্ঞা নির্ধারিত, তার বাইরের কিছু গ্রহণ করা সম্ভব নয়। গুরু দত্ত তাই এই আর্থসামাজিক কাঠামোয় একজন চিরবহিরাগত। গুরু দত্তের শিল্পচেতনার পাঠ উদয়শংকরের শিক্ষায়তনে। উদয়শঙ্কর পরিচালিত ‘কল্পনা’ ছবির শেষদৃশ্যে যেমন আমরা দেখি সস্তা মুখরোচক বাজারে খুব বিকোয় আর শিল্পীর আত্মপ্রকাশের ব্যর্থতার বেদনা গুমড়ে কাঁদে, তেমনি গুরু দত্তের এই ছবিগুলোতে তাঁর শিল্পীসত্তার সেই যন্ত্রণা উঠে এসেছে চলচ্চিত্রের সুষমায়। নিজের সময় থেকে অনেক এগিয়ে থাকা মানুষটি সম্ভবত রিল লাইফ আর রিয়েল লাইফের মধ্যে অলঙ্ঘ্য প্রাচীরটা ভেঙে ফেলেছিলেন। তাঁর নিজস্ব স্বপ্ন, ভালবাসা আর সৃষ্ট সিনেমা মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। মাত্র দুটি দশকে হিন্দি সিনেমার জগতে যা রেখে যান, তা আজও অনুসরণ, অনুকরণযোগ্য বলে তাঁর অনুজ চলচ্চিত্রকারেরা বিশ্বাস করেন।
তথ্যসূত্র
১। নাসরিন মুন্নি কবির পরিচালিত তথ্যচিত্র In search of Guru Dutt
২। Rashmi Doraiswamy: Guru Dutt: Through Light and Shade
৩। Nasreen Munni Kabir: Guru Dutta: A Life In Cinema
৪। Sathya Saran: Ten Years with Guru Dutt; Abrar Alvi’s Journey
৫। Yasser Usman: Guru Dutt: An Unfinished Story. এবং অন্যান্য