বীরভূম জেলায় বোলপুরের পাশাপাশি অন্যতম একটি লোকসভা কেন্দ্র বীরভূম লোকসভা কেন্দ্র। এই কেন্দ্রটিতে ১৯৫২ সাল থেকেই লোকসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। দুবরাজপুর, সিউরি, সাঁইথিয়া, রামপুরহাট, হানসান, নলহাটি ও মুরারই বিধানসভা কেন্দ্র নিয়ে বীরভূম লোকসভা কেন্দ্রটি গঠিত। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ১৪ লক্ষ ৯৫ হাজার ১০৮ জন ভোটার এই কেন্দ্রে ভোটদান করেছে। ১৯৬২ থেকে ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচন পর্যন্ত বীরভূম কেন্দ্রটি তফশিলি জাতিদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনে সংরক্ষণমুক্ত কেন্দ্র হিসেবে এটি পরিচালিত হয়। ঐতিহাসিকভাবে জাতীয় কংগ্রেস এবং সিপিআইএম বীরভূম লোকসভা কেন্দ্র জয়ী হলেও বর্তমানে এই কেন্দ্রটি তৃণমূল কংগ্রেসের দখলে।
পরপর তিনবারের সাংসদ শতাব্দী রায় এবারও তৃণমূল প্রার্থী। তাঁর বিপক্ষে এবার বিজেপির প্রার্থী দেবতনু ভট্টাচার্য। তাদের প্রথম পছন্দের প্রার্থী প্রাক্তন পুলিশ অফিসার দেবাশিষ ধরের মনোনয়ন খারিজ হয়ে যাওয়ায় ব্যাকআপ দেবতনুর ওপরেই এখন ভরসা। কিন্তু এখনও নিচুতলায় কিছুটা এই নিয়ে ধন্ধ থেকে গিয়েছে বলে খবর। অন্যদিকে দীর্ঘদিনের নেতা দুধকুমার মণ্ডল টিকিট না পাওয়ায় তাঁর অনুগামীরাও কিছুটা অসন্তুষ্ট। ফলে অনুব্রত গড়ে তাঁর অনুপস্থিতির ফায়দা বিজেপি নিতে পারবে কিনা, সেটা এখনও স্পষ্ট নয়। অন্যদিকে কংগ্রেসের মিল্টন রশিদ আছেন লড়াইয়ে। তিনি কতটা সংখ্যালঘু ভোট কাটতে পারেন, সেদিকে কড়া নজর থাকবে শতাব্দী রায়ের কারণ গতবার এই ভোটই তাঁকে দিল্লি পৌঁছে দিয়েছিল।
১৯৫২ সালের লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্র থেকে জাতীয় কংগ্রেসের অরুণ কুমার চন্দ্র জয় লাভ করেন। ১৯৫৭ সালের লোকসভা নির্বাচনে জাতীয় কংগ্রেসের কমল কৃষ্ণ সেন জয়ী হন৷ এস কে দাস ১৯৬৭ সালের লোকসভা নির্বাচনে জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে জয়ী হন। ১৯৭১ সালের লোকসভা নির্বাচনের এই কেন্দ্রটি সিপিআইএমের দখলে আসে। ১৯৭১ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত গদাধর সাহা সিপিআইএমের পক্ষ থেকে এই কেন্দ্রে সাংসদ নির্বাচিত হন। এই সময়ে দ্বিতীয় স্থান অধিকারী জাতীয় কংগ্রেসের প্রার্থীদের থেকে ৮ শতাংশ থেকে ৯ শতাংশ ভোটের মার্জিনে জয়ী হন গদাধর সাহা। ১৯৮৯ সালে নির্বাচনে এই কেন্দ্রে সাংসদ নির্বাচিত হন সিপিআইএম প্রার্থী রামচন্দ্র ডোম। ১৯৯৪ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময় রামচন্দ্র ডোম প্রত্যেকটি লোকসভা নির্বাচনে জয়ী হবে। ১৯৯৮ সালে ১৯৯৯ সালের নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য হবে ভারতীয় জনতা পার্টি দ্বিতীয় স্থান দখল করে।
২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রটি থেকে শতাব্দী রায় সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত হন সিপিআইএম প্রার্থীর ব্রজ মুখার্জিকে ৬০ হাজারের বেশি ভোটে পরাজিত করে। এই লোকসভা নির্বাচনে ৮৩ শতাংশ মানুষ ভোট দানে অংশগ্রহণ করে। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে শতাব্দী রায় ফিরে একবার সিপিএম প্রার্থীকে পরাজিত করে জয়ী হন। এই নির্বাচনে তৃতীয় স্থানে ছিল ভারতীয় জনতা পার্টি। তবে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে দুধ কুমার মণ্ডল ভারতীয় জনতা পার্টি পক্ষ থেকে ৩০ শতাংশ ভোট পান। শতাব্দ রায় ৩৬ শতাংশ ভোট পেয়ে সাংসদ নির্বাচিত হন তৃতীয় বারের জন্য। এই লোকসভা নির্বাচনে ৮৫ শতাংশ মানুষ ভোটদানে অংশগ্রহণ করেন।
বীরভূম লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত বিধানসভা কেন্দ্রগুলিতে ২০২১ সালের ফলাফলের দিকে নজর রাখলে দেখা যাবে, তৃণমূল কংগ্রেসের একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় থেকেছে এই বিধানসভার ক্ষেত্রগুলিতেই। রামপুরহাট কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেসের অসিত ব্যানার্জি ৮৪৭২ ভোটে জয়যুক্ত হন। হানসান কেন্দ্রে ৫০ হাজারের বেশি ভোটের ব্যবধানে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী জয়ী হন। অন্যদিকে মুরারই বিধানসভা কেন্দ্রে ডঃ মোশারফ হোসেন তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে ৯৮ হাজারের বেশি ভোটে জয়ী হন। দুবরাজপুর কেন্দ্রে বিজেপির অনুপ কুমার সাহা তৃণমূলের প্রার্থীকে ৪ হাজারের বেশি ভোটে পরাজিত করেন। সিউড়িতে বিকাশ রায়চৌধুরী তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে বিধায়ক নির্বাচিত হন ৭ হাজারের বেশি ভোটের ব্যবধানে জিতে। সার্বিকভাবে বীরভূম লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেসের আধিপত্য বজায় থাকলেও ভারতীয় জনতা পার্টির আধিপত্য অনেকেই বৃদ্ধি পেয়েছে আগের তুলনায়।
সেই জন্যই এবার বীরভূম আসনটি পাওয়ার বিষয়ে আশাবাদী ছিল গেরুয়া শিবির। তবে প্রার্থী নির্বাচন নিয়ে সমস্যায় তাদের আশা কিছুটা হলেও ধাক্কা খেয়েছে। তবে যেভাবে শতাব্দী বিভিন্ন স্থানে প্রচারে গিয়ে বিক্ষোভের মুখে পড়ছেন, সেটা কিছুটা হলেও অস্বস্তিতে রাখছে প্রাক্তন অভিনেত্রী। শতাব্দী যদিও বলছেন মানুষের ভালোবাসা সেটা। তবে বাস্তবে সেটা কী, তা মানুষ ঠিক করবেন চতুর্থ দফার ভোটে ১৩ মে-তে। ফলাফল জানতে অবশ্য অপেক্ষা সেই ৪ জুন অবধি।